ঘুরে দাড়ানোর গল্প

আমি খুব সাধারন একজন স্কুল ছাত্রী।নবমে পড়ি। জেলা সদরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে।এটা একটা কলেজিয়েট স্কুল।আমি গ্রামের মেয়ে।মামার বাসায় থেকে পড়াশুনা করি।

পঞ্চমে এবং অষ্টমে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় সবাই আমার পড়ালেখায় সহযোগিতা করে এবং আমাকে সবাই খুব ভালবাসে।আমিও অনেক মনযোগ দিয়ে পড়ি।পাঠ্য বই ছাড়াও নানারকম বই আমি নিয়মিত পড়ি।সাইন্স ফিকশন,ভ্রমন কাহিনী, বিখ্যাত লেখকদের মোটিভেশনাল স্পিচ নিয়ে লেখা বই,উপন্যাস,দৈনিক পত্রিকা,কলাম সহ আরো নানা রকম বই আমি পড়ি।আমার হেপী মেম এই বিষয়ে আমাকে সহযোগিতা করেন।মেম ইংরেজী সাহিত্যের প্রফেসর।তার লেখা অনেক বইও আছে যা স্কুল কলেজের বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়ানো হয়।

হঠাৎ একদিন শুনলাম মেম বিদেশ চলে যাবেন।কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াতে যাবেন।চোখের পানিতে সবাই তাকে বিদায় জানালাম।আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলামনা।মেমকে জড়িয়ে অনেক কাঁদলাম।মেম আমাকে বেশ কিছু বই দিলেন।আর মামার ফোন নংটা নিয়ে মোবাইলে সেভ করলেন।

স্কুলে গিয়ে এখন আমার আর ভালো লাগেনা।নবমে উত্তির্ণ হওয়ার পরে এমন কঠিন সময় আর আমার আসেনি।ক্লাস করতে ভালো লাগেনা,বাসায় পড়তে ইচ্ছে করেনা।মামাও আজকাল অনেক ব্যস্থ হয়ে পড়ায় আর কাউকে পাইনা কথা বলার মতো।মামী সারাদিন সংসার নিয়ে ব্যস্থ।আমি কোন কাজে সাহায্য করতে চাইলে করতে দেয়না।ভালো মন্দ নানা কথা বলে।

:বুঝলে তোমার মামা তোমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে জজ,বেরিসটার বানাবে।এখন যদি আমি কোন কাজে লাগাই তোমারে আর উনি জানতে পারেন তবে আমার কপালে দুঃখ আসবে।দরকার নাইগো মা।তুমি যাও পড়োগে।

মামাত বোন ইতি।পঞ্চমে পড়ে।সেও ব্যস্থ তার পড়া আর বন্ধুদের নিয়ে।মামাত ভাই রবি ভাইয়া অনার্স ফাইনাল দিয়ে বি,সিএসের জন্য তৈরি হচ্ছেন।খুব গম্ভীর মানুষ।তার কাছে গেলে তিনি হয়তো বকবেন

না।কিন্তু কি বলবো তার সাথে।

মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াই বাসায়।বিকেল বেলায় জানালার ধারে বসে গান গাইছিলাম।একা একা থাকলে অনেক সময় আমি গলা ছেড়ে গান গাই।

সবাই আমার গান পছন্দ করে।তাই এই বিষয়ে আমার কোন দ্বিধা সংকোচ নাই।হঠাৎ গান শেষ হলে পাশ ফিরে দেখি রবি ভাইয়া।কেমন মুগ্ধ হয়ে আমার গান শুনছিলো।সেও খুব প্রশংসা করে আমার গানের।

তাই তার অনুরোধে আরো কয়েকটা গান শুনাই।

আজকাল রোজ রোজ তাকে আমার গান শুনাতে হচ্ছে।না করলে অভিমান করে।একদম বাচ্চাদের মতো।আমি আর না করিনা।আস্তে আস্তে আমরা কাছাকাছি চলে আসি।

রোজ একবেলা আমাদের আড্ডা,গল্প,গান চলতে থাকে।সকলের অজান্তে।আজ সবাই গেছে মার্কেটিং করতে।বাসায় কেবল আমি আর রবি।আমার ঘরে বসে বসে পড়ছিলাম।হঠাৎ চমকে উঠলাম কেউ একজন আমার দুইচোখ চেপে ধরায়।দুহাতে শক্ত করে ধরায় আমি পিষ্ট হচ্ছিলাম।ফিসফিসিয়ে বললো,আমি কে বলতে না পারলে ছাড়বোনা।

জীবনে প্রথম পুরুষ হাতের ষ্পর্শ তাও আবার প্রিয়

মানুষের হাতের।কি যে ভালো লাগছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।সারা দেহে অদ্ভুত এক শিহরন।

মনে মনে কামনা করছিলাম এই মধুর প্রহর যেনো দীর্ঘ হতে হতে বহুদূরে চলে যায়।মনে হয় রবিও প্লেন করে এসেছিলো তাই সেও আমাকে ছাড়ছেনা।ডাকাতের মত আচরন করছে।আর আমি লুট হতে হতে একেবারে শেষ হয়ে যেতে চাইছি।বাইরে জমজম করে বৃষ্টি হচ্ছে।

আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে।যেন সন্ধা পেরিয়ে গেছে।নিরব নিস্তব্ধ চারপাশ।আমাদের পাগলপণা বাড়তে বাড়তে যখন সীমা ছাড়ালো তখন আমি সর্বহারা এক পঞ্চদশী।কেমন একটা কান্না কন্ঠটাকে ছিড়ে বেরিয়ে আসে।আমি হুহু করে কাঁদতে থাকি।

রবি অপরাধীর মত চুপচাপ চলে যায়।

কি অদ্ভুত এক নেশায় আমি মাতাল হয়ে যাই।রোজ রোজ রবিকে কোন না কোন এক সময় আটক করি।

সেও আপত্তি করেনা।দিনে রাতে।সব সময় মাথায় কেবল একটা চিন্তাই কিলবিল করে।

আমার লেখাপড়া খুব খারাপ হতে লাগলো।কথায় বলেনা কিছু লোককে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো গেলেও সব সময়ের জন্য কাউকেই বোকা বানানো যায়না।তাই আমিও আমার লেখাপড়ার দৃরাবস্থা বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারিনি।বার্ষিক পরীক্ষায় আমি নবম থেকে কোনরকমে দশমে উঠলাম।

মামা খুব অসন্তুষ্ট হলেন।মুখ ফুটে কিছু না বললেও আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিলেন।এরই মধ্যে একদিন ঘরের সবাই জেনে গেলো আমাদের এই সম্পর্কের কথা।রবিকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন মামা।

মামী অনেক কান্নাকাটি করলেন।

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।আবেগে ভেসে গিয়ে বিবেক বিবেচনা সব বিসর্জন দিয়ে অমানুষে পরিণত হয়ে গেলাম।আমার জন্য একটা সংসারে অশান্তি হচ্ছে।একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করবো।

কিন্তু যখন ভাবলাম এটা পুলিশ কেস হবে তখন ভাবলাম বাড়িতে চলে যাবো।কিন্তু বাড়িতে গিয়ে বাবা মাকে কি বলবো?মামাতো অনেক ছোট হয়ে যাবেন।

ভাবতে ভাবতে অবশেষে ঠিক করলাম আমি আবার ঘুরে দাড়াবো।আবার মন দিয়ে পড়বো।ভালো রেজাল্ট করবো।আমার ঘরে আমি নিজকে বন্দী করলাম।যদিও মামা সব দোষ রবিকেই দিয়েছেন কিন্তু মামী তার আঙুল আমার দিকেই তুলেছেন।তবে মামার কারনে আমার সাথে বেশি কিছু করতে পারছেন না।সেই সুযুগে আমি আবার নবোদ্যমে আমার লেখাপড়া শুরু করলাম।মামাও আমার দিকে আর তার মেয়ে ইতির দিকে কড়া নজর দিলেন।

আস্তে আস্তে আমি এগিয়ে চলছি।ইতিমধ্যে আমার এস,এস,সি পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে গেলো।ভালই দিলাম।মনে প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।বাবা মাকে বহুদিন ধরে দেখা হয়নি।ফোনে কথা বলে কি আর দেখার তৃপ্তি মেটে?তাই একদিন বাবার সাথে বাড়ি চলে গেলাম।সময় আর কাটতে চায়না।কাজ না থাকায় কত চিন্তা যে মাথায় আসছে!

আজ কেন জানি মনটা খুব অস্থির অস্থির লাগছে।কোথাও মন টিকছেনা।ঘর বাহির করছি।হঠাৎ মা এসে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিলেন।হেলো বলতেই যে কন্ঠটা শুনলাম তা কল্পনাও করিনি।

রবির ফোন।

:কেমন আছো নীনা?

আমি স্তব্ধ হয়ে আছি।কি বলবো বুঝতে পারছিনা।

এই একটা কঠিন রোগ আমার।মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে আমি বিমূঢ় হয়ে যাই।

:তোমার জন্য দুটো সুখবর আছে।একটা ব্যক্তিগত আরেকটা যৌথ।কোনটা বলবো আগে?আমি জানি তুমি ভালো নেই।তাই এই বিষয়ে কিছু বলার দরকার নেই।কেবল শুনে যাও আমি যা বলি।

:তুমি কেমন আছো রবি?আমার জন্য আজ তুমি বাড়ির বাইরে….

:আরে শুনো,খোদা যা করেন মানুষের ভালোর জন্যই করেন।আর হয়েছেও তাই।

:আমি কোনো খবর শুনতে চাইনা।কেবল বলো তুমি কেমন আছো,কোথায় আছো?তুমাকে একটা নজর দেখতে চাই।দেখা দেবে?

:শিঘ্রই দেখা পাবে আমার।তার আগে খবর দুটো শুনবে তো?তুমি শুনতে না চাইলেও আমি বলার জন্য একেবারে পাগল হয়ে আছি।

:হুম জানিতো তুমি যে কি পাগল।নতুন করে কি আর পাগল হবে,পাগলু?বলো শুনি তোমার সু….

:১মটা আমার।এটাকেই যৌথ বলছি।আমার অনার্সের রেজাল্ট হয়েছে,আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি।আর তোমার রেজাল্ট হবে আগামী কাল।আমি বোর্ডে গিয়ে কিছু টাকা পয়সা খরচ করে তোমার রেজাল্ট নিয়ে এসেছি।সব কটাতেই ৯৯%নম্বর তুমি পেয়েছো।

কংগ্রেটস।টেইক মাই লাভ।

:আচ্ছা শুনলাম তোমার সুখবর।এখন আমায় বলো কবে আমাদের দেখা হচ্ছে?

:কি হয়েছে তোমার নীনু?তুমি খুশি হওনি?

:খুশি হতাম,যদি তুমি আমার সামনে দাড়িয়ে খবর দুটো দিতে।

:টেনশন করোনা,খুব শিঘ্রই আরেকটা ভালো খবর দিতে পারবো তোমায়?

:আমার লাগবেনা আর কোন সুখবর।শুধু তোমায় একটাবার দেখতে চাই।

আজকের দিনটা আমার জন্যই সত্যিই অনেক আনন্দের।আমি আবার ফিরে এসেছি মামার বাসায়।

মামা নিয়ে এসেছেন।আমার রেজাল্ট আমি পেয়ে গেছি।৯৯% নম্বর পেয়েছি।রবিও ফিরে এসেছে বাসায়।

একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি পেয়েছে সে।ভালো সেলারি।সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে।দীর্ঘ দিন বাসার বাইরে থাকায় মামী খুব কাঁদলেন রবিকে ধরে।রবিও কাঁদলো।আমি আড়াল থেকে নিরবে চোখ মুছলাম।

সবাই খুব খুশি আজ।ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে।

কেবল নিজের ঘরে বসে ছটফট করছি আমি।যে মামীকে আমি মনে করতাম আমায় পছন্দ করেনা অবশেষে সেই মামীই রবিকে হাত ধরে আমার ঘরে এসে দিয়ে গেলেন।যাবার সময় বলে গেলেন,

দেখো মেয়ে,আবার যেনো তোমার জন্য আমার ছেলেকে বাড়ি হতে বের হতে না হয়।মামী চলে যেতেই আমি রবিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি।সেও আমায় দুহাতে আকড়ে ধরে।কান্নায় যে এতো সুখ আছে আগে জানা ছিলোনা।সত্যিই জানা ছিলোনা।

লিখেছেন: আমিনুল হক জাহাঙ্গীর।

Related posts

বৃদ্ধাশ্রমের চিঠি

গভীর রাতের ট্রেন

শান্তির অন্বেষণে