মুনালিসা। আজিজ শেখের স্ত্রী। দেখতে খুব সুন্দরী। হেমামালিনীর মত। সেকালে কি সুন্দরী কি অসুন্দরী পর পুরুষের সহিত কথা বলিলেই যেন জাত যাইতো।
একদিন স্বামী আজিজ শেখ যখন নিজ চোখে দেখিলো স্ত্রী মুনালিসা বাঁশঝাড়ের নীচে এক সুদর্শন যুবক পুরুষের সহিত ফিসফিস করিয়া কথা কহিতেছে তাহা দেখিয়া আজিজ শেখের মনে ভীষণ ক্ষুভের জন্ম হইলো। বেশ কিয়ৎকাল যাবৎ আজিজ শেখ ও তাহার স্ত্রী মুনালিসার মাঝে মনের অমিল চলিতে থাকিলো। এতোটাই অমিল যে আজিজ শেখ চোখে মুখে আন্ধার দেখিতে লাগিলো। তাই মাঝে মধ্যে হেমামালিনীর কথা ভেবে ভেবে স্মৃতির অতল গহব্বরে হারিয়া যায়।
সে অনেক দিন আগের কথা। ষাটের দশক। আজিজ শেখ তখন তরুণ, যোবক পুরুষ। বিয়েও করেনি। রামপাল চক্রবর্তী সেকালের প্রভাবশালী জমিদার। একদিন জমিদার কোন এক অপরাধের দায়ে আজিজ শেখের বাবা রইছ শেখকে দরবারে তলব করিয়া বসিলে বাবার সহিত আজিজ শেখও জমিদারের সামনে হাজির হয়। জমিদার অপরাধের দায়ে শাস্তি স্বরুপ বাবা রইছ শেখকে নিজ হাতে বেত্রাঘাত করিলে ইহা দেখিয়া আজিজ শেখের মনে ভীষণ ক্ষুভের জন্ম নেয় এবং সেই থেকে জমিদারের প্রতি আজিজ শেখের আক্রোশ দিনে দিনে বাড়তে থাকে।
বড়ই আক্রোশ তার। চোখের সামনে বাবার এহেন অপমান তাকে যেন প্রতিনিয়ত তাড়া করিতে থাকে। মনের যন্ত্রণা মনের মাঝেই চাঁপা রাখিয়া প্রতিশোধের পথ খুজিতে থাকে।
ভাবে কি করিবে সে। কি করিলে জমিদারের জৌলুস মান ইজ্জতভ্রষ্ট হইয়া যাইবে। প্রতিটিক্ষণ আজিজ শেখের মনে একটাই চিন্তা একটাই ভাবনা প্রতিশোধ নিতে হবে প্রতিশোধ।
আজিজ শেখ তখন ক্লাস টেন এ পড়ুয়া মেধাবী স্টোডেন্ট। ভাবতে ভাবতে একসময় একটা বুদ্ধির উদয় ঘটিয়ে বসে সে।
দুরের স্কুল। আজিজ শেখ যে স্কুলে রোজ পড়িতে যায় সে স্কুলের টিচার হলেন কাজী শরাফত আলী উরফে সাইন্স স্যার। সাইন্স এর টিচার তিনি। তাহা ছাড়া কথায় কথায় সাইন্স বিষয়ে আলোচনা গবেষণা পর্যালোচনা করিয়া থাকেন বলিয়া সকলে তাকে সাইন্স স্যার বলিয়া সম্মোধন করিয়া থাকে।
রোজ সাইন্স স্যার জমিদারের বাসায় গিয়ে জমিদারের একমাত্র মেয়ে হেমামালিনীকে পড়াইয়া আসেন। বিষয়টা আজিজ শেখ উদঘাটন করে। আজিজ শেখের সহিত সাইন্স স্যারের বেশ দহরমমহরম আগে থেকেই তাও আবার সম্পর্কটা এমন যেনো দাদা আর নাতির মতই নিবিড়।
কথাটা জানিবার পর আজিজ শেখ বুদ্ধিতে পরিপক্কতারখাটুনি খাটাইতে লাগিলো। একদিন অনেক প্রকার ফলমূল, দই মিষ্টি আর সবড়ি কলার বাদা এক সাথ করে নিয়ে সাইন্স স্যারের বাড়িতে হাজির হলো। অনেক ধরনের দামীদামী ফল তাও আবার পরিমানে অনেক। দই মিষ্টি, কলা এতোসব দেখিয়া সাইন্স স্যারের চোখ দুটি যেনো কপালে উঠিলো।
স্যার মানুষ। স্টোডেন্টদেরকে নিয়েই যার জীবনের অধিক কাল যাপন সে আবার কি করে বুঝিতে না পারে যে আজিজ শেখের মতিগতির কিছুটা ভিন্নতা আছে তাহা সাইন্স স্যাররের আচ করতে খুব একটা বেগ লাগিলো না। সাইন্স স্যার বলিয়া উঠিলেন, কিরে নাতি কি মতলব নিয়ে আসিয়াছিস শুনি।
আজিজ শেখ মৃদু হাসির ঝলক মারিয়া কহিল, কি আর মতলব নানা, ঐ যে জমিদারের মেয়ে হেমামালিনী। ওর সহিত আমার শুধু একটু কথা বলাইয়া দিবেন এর অধিক কিছু নয়।
প্রথমে সাইন্স স্যার রাজি হতে বাকবিতন্ডা করলেও আজিজ শেখের লোভ দেখানো পাঁচ কেজি রসগোল্লা সাথে আবার বুড়ির বাড়ির ছানার মিষ্টির আহারে এ লোভে কে না হার মানে। এবার সাইন্স স্যারও হার মানলেন।
হেমামালিনী দেখতে খুব সুন্দরী। যেমন তার গায়ের রঙ তেমন তার গঠন যেনো চাঁদের মত উজ্জল আলোর ঝর্ণা। একবার চোখ পড়লে কয়েকবার তাকানো ছাড়া কারো কোন গতি থাকেনা । কিন্ত সকলের চোখে যে সে পড়বে তার কোন কায়দা নেই। কারণ জমিদারের মেয়ে বলে কথা। চার চকিদারের তত্ত্বাবধানে পালকি করে রোজ মালিনীকে স্কুলে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে।
সাইন্স স্যার অনেক কৌশল করে মালিনীর সহিত আজিজ শেখকে দেখা করার সুযোগ করে দেন। তাও আবার স্যারের নিজ বাড়ির এক নির্জন কক্ষে। স্যার বলে কথা। স্যার একটা আদেশ করলে একজন ষ্টোডেন্ট এর পক্ষে না করাটা দুরুহ ব্যপার তাই হেমামালিনীও স্যারের কথাটি ফেলতে পারেনি।
বসে আছে মালিনী। একদম নির্ভয়ে। হঠাত আজিজ শেখ রুমে প্রবেশ করে। কোন কথা নয়। রমারম মালিনীর মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে ফেলে। হাত দু’টিও বেঁধে জোর পূর্বক ইজ্জত হরণ করে। শুধু তাই নয় নরপিষাচের মত সমস্ত শরীরে জখম করে দিয়ে পালিয়ে যায়। মালিনী তখন বিবস্রপ্রায় অচেতনতায় পড়ে থাকে। সাইন্স স্যার ইচ্ছা করেই দূরে অবস্থান করছিলেন। হঠাত আজিজকে দৌড়ে পালানোর দৃশ্যটা স্যারকে ভীষণ ভাবে বিচলিত করে তোলে। স্যার দৌঁড়িয়ে যে রোমে মালিনীকে রেখে গিয়েছিলো সেই রোমে ঢুকে।
একি! ভয়ানক দৃশ্য! হৃদয় বিদারক, সাংঘাতিক!
দৃশ্য দেখে সাইন্স স্যারের মাথায় বজ্রপাত হতে থাকে। প্রথমে মালিনীর বিবস্রতা দূর করে পরে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে বেহুশ অবস্থায় আছে। সগোপনে নিজেই তার মাথায় পানি ঢালে। যখন জ্ঞান ফিরে মালিনীর দু’চোখ ভরে অশ্রু আর অশ্রু। স্যার লাজ সরমের মাথা খেয়ে মালিনীর পায়ে পড়ে কেঁদে ফেলে। কাঁদছে আর কাঁদছে কান্না চোখে ক্ষমা ভিক্ষা প্রার্থনা করছে সাইন্স স্যার। কারণ সাইন্স স্যার জানে এর পরিনতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে। স্যারের এমন আকুতি মিনতিতে মালিনীর মনে দয়ার উদয় হয়।
একদিকে নিজের ইজ্জত, জমিদার বাবার ইজ্জত অন্যদিকে স্যারের নিশ্চিত জীবন নাশের কথা ভেবে মালিনী আপন শরীরের ক্ষত গুলো ঢাকার নির্মিত্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্যার কে বলে, স্যার আপনি আমার স্যার, আমার এহেন পরিস্থিতির কথা কেবল আপনি আমি আর সেই জানে যে আমার চরিত্র হরণ করেছে। আপনার কাজ থাকবে। ওর সহিত আমার বিয়ের ব্যবস্থা করা। যে আমার ইজ্জত দেখেছে আমি তার কাছেই সমর্পিত হতে চাই। বাকি সব আমি দেখবো।
স্যার যেন কিছুটা হলেও দেহে প্রাণ ফিরে পায়। মালিনীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমার জ্ঞানের শপথ- আমি তোমার কথা মত বাকী জীবন কাজ করে যাবো। তাই যেন থাকে-কথাটি বলেই ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে মালিনী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে প্রতিদিনের মত মালিনীকে নিতে পালকী নিয়ে হাজির “চার” চৌকিদার। মালিনিও কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পালকীতে আরোহন করে। মালিনী হাস্যোজ্জ্বল বদনেই তার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। মুখে সুমিষ্ট হাসি কিন্তু দেহে বিষাক্ত সর্প ছুবলের নির্মম যন্ত্রণা।
কয়েকদিন হেমামালিনী আর স্কুলে যায় না। কিন্তু গৃহ শিক্ষক সাইন্স স্যার নিয়মিতই পড়াতে মালিনীর গৃহে হাজির হয়। আগের মত সচ্ছল হাসিখুশি নেই। মনে বিষন্নতার মেঘ নিয়েই সাইন্স স্যার প্রবেশ করে জমিদার বাড়িতে।বিষয়টি কেউ উপলব্দি করতে না পারলেও হেমামালিনী তা নিশ্চিত উপলব্দি করে। মালিনীও যতক্ষণ স্যারের পাশে থাকে ততক্ষন সেও মনমরা হয়ে থাকে। আগে যে টেবিলে পড়া লেখা হতো এখন সেই টেবিল ভরে যেন ঔষধের ছড়াছড়ি। স্যার এখন আর পাঠ্য বইয়ের জ্ঞান দেন না, জ্ঞান দেন তার অসুখের। জ্ঞান দেন সমস্যা সমাধানের।
হেমামালিনীর একদিকে শারিরিক অসুস্থ্যতা অন্যদিকে মানসিক চাপও প্রকট। এমনি চাপ যে, অন্য কাউকে তা শেয়ার করাও যায় না। তাই সাইন্স স্যার এখন মালিনীর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। দু’জনে শলা পরামর্শ করে। কি করা যায়। কি উপায়ে আজিজ শেখকে ফিরে আনা যায়। মালিনীর এহেন মনের কথা যেন সাইন্স স্যারের বুঝতে কিছুটা সমস্যা হয়। মনে মনে ভাবে- জমিদারের একমাত্র মেয়ে। তাছাড়া ধর্মের কি বিরাট ফারাক। অথচ হেমামালিনী আজিজ শেখকে বিয়ে করতে চায়?
এ কি করে সম্ভব! কিন্তু হেমামালিনীর একটাই কথা তার আজিজকে চাই। তাকে শাস্তিতে ঝুলানোর বদৌলতে নাকি বাগদত্তা বলে প্রনাম করবে। এই নিয়েও সাইন্স স্যার যেন রীতিমত ভাবনায় পড়ে যায়।
যতই দিন যায় সাইন্স স্যারের উপর হেমামালিনীর চাপ বাড়তেই থাকে। কোন উপায় খোঁজে পায়না। সারাক্ষণ ভাবতে থাকে, ভাবতে থাকে। আজিজ শেখকে কোথায় খুজে পাবে স্যার। সে কি আর হাতের নাগালে আছে? কিন্তু তাকে যে হেমামালিনীর চাই-ই চাই।
এদিকে আজিজ শেখ ঘটনার পরক্ষণেই বাড়ি ছেড়েছে। কোথায় গিয়েছে সে তাহা কেউ জানে না। মাঝে মধ্যে সাইন্স স্যার একজন স্কুল টিচার হিসাবে খোঁজ খবর নিতে আজিজ শেখের বাড়িতে যায়। তার বাবা রইছ শেখ এর সহিত শলা পরামর্শ করে। এ গ্রাম সে গ্রাম থানা পুলিশ সবার কাছেই তথ্য দেয়। নীরবে হন্যে হয়ে খোঁজ কররে থাকে সাইন্স স্যারও।
কোথাও আজিজ শেখের খোঁজ মিলেনা। আর ওদিকে এতোদিনে প্রতিশোধ নয় হেমামালিনী যেন মনের রাজ্যে আজিজ শেখকে মনের রাজা বানিয়ে বসেছে। কোন ক্ষোভ যেন আজ আর তাকে তাড়া করে ফিরেনা। হেমামালিনী ভাবে-কি দুঃসাহসী পুরুষ। জীবনের সংগী হিসেবে এমন সাহসী পুরুষ থাকা চাই। জমিদারের কন্যা আমি জেনেও যে এতোটা সাহস দেখাতে পারে সেই আমার মনের রাজ্যের রাজা হবে। শরীরের সকল ক্ষত যেন আজ স্মৃতির পসরা হয়ে দাঁড়িয়েছে মালিনীর। অনুভব করে সে সকল স্পর্শের। স্পর্শ কাতর হয়। শিহরিত হয়। পুলকিত মনে কবিতা চয়ন করেঃ
“এমন স্পর্শে তুমি আনিলে গো শিহরণ
আমি চকিত চয়নে খুজি তোমায়
তূমি যে কাড়িয়াছ মন।”
হেমামালিনী রোজ সাইন্স স্যারকে ডাকে। আগে স্যারকে খুব বেশি জব্দ করতো। এখন আর করে না। এখন যেন অনুরোধ অনুনয় বিনয় এর সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝে জোশ গল্পেও দু’জনে হাসি খুশিতে ভরে থাকে। সাইন্স স্যারের এখন আর আগের মত ভয় কাজ করেনা। কিন্ত ভয় একটাই যদি আজিজ শেখকে কোনদিন ফিরিয়ে না আনা যায় তবেই যে তার প্রাণ নাশের হুমকি হবে।
দিন যায় যতই হেমামালিনীর চাহিদা যেন ততই বাড়তে থাকে। কিন্ত সাইন্স স্যারের নিশ্চিত আশার বাণী মালিনীকে শান্ত করে রাখে।
এদিকে আজিজ শেখ যেদিন হেমামালিনীর ইজ্জত হরণ করিল সেদিনই নিরুদ্দেশ হইলো। যখন রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় বসেছিল লাইনের উপর বিষন্ন মনে। কেউ তাকে এতটুকু মনেও করিয়ে দেয়নি যে এই লাইনেই ট্রেন আসছে। রেললাইনে বসে বসে আজিজ শেখ ভাবে কত বড় অন্যায় কাজই না করিল সে। যার শাস্তি স্বরুপ নিশ্চিত বাপের মায়ের গলা কাটা যাবে। ভাবতে ভাবতে দিশেহারা হয়ে পড়ে আজিজ শেখ।
এ আমি কি করলাম। ট্রেন আসছে। হুইসেল বাজছে। আজিজ শেখের কানে যেন কোন শব্দই যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে যেন সে পাথর হতে বসেছে। ট্রেন একদম নিকটবর্তী। বিষয়টি রেলওয়ে পুলিশের চোখে পড়লে তাৎক্ষণিক তাকে ধাক্কা দিয়ে লাইন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ভাগ্যক্রমে আজিজ শেখ বেঁচে যায়। দ্রুতগামী ট্রেনটি পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
এমন পরিস্থিতির কারণে পুলিশ তাকে জব্দ করলে সে বিচলিত হয়ে উল্টাপাল্টা জবাব দেয়। এবং ইচ্ছে করেই আসল তথ্য গোপন করে। কারণ আজিজ শেখের ধারণা গ্রামে ফিরলেই যে তাকে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে।
বেশদিন যাবত আজিজ শেখ পুলিশের হেফাজতে আছে। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও আজিজ শেখের মুখ থেকে সঠিক তথ্য বের করতে না পারায় তাকে জেল খানায় বন্দী করে রাখে।
দিনতো অনেক হলো। এদিকে আজিজ শেখকে যখন খুজেই পাওয়া যাচ্ছিলোনা তখন আজিজের বাবা রইছ শেখ সাইন্স স্যারের পরামর্শক্রমে থানায় জিডি করে রেখেছিলো।
একদিন হঠাৎ আজিজ শেখের বাবা রইছ শেখের নামে টেলিগ্রাম আসে। প্রথমত রইছ শেখ ভীষণ ভয় পেলেও পরে বিষয়টা যখন অবগত হয় রইছ শেখের মনটা কষ্টের মাঝে খুশিতে ভরে উঠে। কিন্তু পুনরায় ভীষণ রুপে বিচলিতও হয় এই ভেবে যে, না জানি কোন অপরাধের দায়ে ছেলেকে পুলিশ জেলে রেখেছে।
পুলিশ আগামীকাল দেখা করতে বলেছে। রইছ শেখ একবার ভাবে সাইন্স স্যারকে সংগে নিয়ে যাবে। আবার ভাবে শত হলেও সাইন্স স্যার অপর মানুষ। একবার সমাজে জানাজানি হয়ে গেলে মানসন্মান যে আর থাকবে না তাই ভেবে তার আপন চাচাতো ভাই আবেদ শেখকে সংগে নিয়ে রইছ শেখ পুলিশের কাছে গেলো।
বাবা রইছ শেখ ও চাচা আবেদ শেখ থানায় মুচলেকা দিয়ে আজিজ শেখকে মুক্ত করলো। প্রথমে আজিজ শেখ ভয়ে হোক লজ্জায় হোক বাড়ি ফিরতে অসন্মতি জানালেও তাকে জোর পূর্বক বাড়ি আনা হয়।
অনেকদিন পর আজিজ শেখ বাড়ি ফিরেছে। খবরটা যেন রীতিমত পাড়া মহল্লায় থৈথৈ। সাইন্স স্যারের কানে যখনই পৌছে স্যার ততক্ষনাৎ হেমামালিনীর বাড়িতে হাজির হয়। হেমামালিনী খবরটি শুনে রীতিমতো খুশি হয়। সাইন্স স্যারকে বলে, স্যার আমিও আপনার সহিত আজিজ শেখের বাড়িতে যাবো। শলা পরামর্শের পর মালিনীর সেদিন আর যাওয়া হলো না।
প্রস্তুতি চললো একেবারেই ঘর ছাড়ার। অলংকার সামগ্রী এমনভাবে গুছালো যেন সারা জীবন কষ্ট করতে না হয়। সাইন্স স্যার খুব কৌতুহলে যখন আজিজ শেখের বাড়ি পৌছিলো দেখতে পেলো, সবার চোখ বেঁয়ে নীরব কান্না ঝরছে। কি হয়েছে, আরে ছেলেকে ফিরে পেয়েছো এতো মহা আনন্দের খবর। এমন সময় কি কেউ কাঁদে? সাইন্স স্যার জানতে চাইলে উত্তরটা এমন ভাবে আসে যেনো সাত আসমান তাহার মাথার উপর ভাংগিয়ে পড়ে। সকলের মুখে বলাবলি কি আর হবার আজিজ শেখ যে ফের পালিয়েছে।
অনেক বছর পর…
আজিজ শেখ বিয়ে করা বউ মুনালিসাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো তখন যে সবই প্রায় শেষাবনত। বাবা রইছ শেখ মা রাবেয়া শেখ উভয়েই মারা গেছে। বাবা মায়ের মৃত্যুর খবর আজিজ শেখকে রীতিমতো নাড়া দিলো।
মনে পড়লো সাইন্স স্যারের কথা,হেমামালিনীর কথা। সেদিন সকল ভয়ভীতিকে দূরে ঠেলে আজিজ শেখ এক গভির রজনীতে সাইন্স সারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হইলো। সাইন্স স্যারও তখন শয্যাশায়ী। যেন কোন রাগ নেই, কোন ক্ষোভ নেই, নেই কোন মান অভিমান। সাইন্স স্যার আজিজ শেখকে কাছে বসিয়ে সুদীর্ঘ দিনের জমানো সকল কথা গুলো বললো আর চোখের জল ফেললো। আজিজও নীরবে চোখের জল ঝরঝর করে ঝরাতে লাগলো।
আপন ভুলের প্রায়শ্চিত্তের প্রয়াসে জমিদার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় আজিজ শেখ। হন্যে হয়ে খোঁজে হেমামালিনীকে কিন্তু মালিনী যে নেই। মলিনতায় ছেঁয়ে গেছে ঐতিহ্য মন্ডিত জমিদার বাড়ির প্রাসাদটি। জমিদারের বৈঠক খানায় এখন শেওলা জমেছে। উঠানে কুকুর বিডালের গাদাগাদি। প্রাচীরের চার দেয়ালে আঁকা আর্তনাদের বাণী।
“আমারে করিয়া ক্ষত
দিন কাড়িলে কত
চাহিয়া তোমার দার
কত চাহিবো আর”
জমিদারও নেই। নেই জমিদারিও। লোটেরা সব ভাগাভাগি করে লুটেছে। একমাত্র উত্তরাধিকারী মেয়ে হেমামালিনী সেও এক অসহ্য যন্ত্রণায় ভোগতে ভোগতে একদিন গলায় দঁড়ি দিয়ে নিজেকে আত্মহুতি দিয়েছে। প্রাচীরঘেসে দাঁড়িয়ে থাকা হরপ্রসাদ এসব আজিজ শেখকে জানায়। আজিজ শেখের দু-চোখ গড়িয়ে ঝরঝরিয়ে পানি ঝরতে থাকে।
লিখেছেন: নুর এমডি চৌধুরী
33 comments
Comments are closed.
Add Comment