আহসান সাহেবের ঘর থেকে কাশির শব্দ ভেসে আসছে। খুকখুক করে কাশির শব্দ নয়, ঘড়ঘড়ে কাশির শব্দ। ঘর কাঁপিয়ে কাশছেন আহসান সাহেব। কাশতে কাশতে বমি করে ফেলবেন এরকম অবস্থা হয়ে ওনার। কাশিটা হয়েছে অনেকদিন ধরেই, ওষুধপত্রও খাচ্ছেন কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না।
ওনার কাশির শব্দ, ইতোমধ্যে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কেয়ারটেকার রহমত মিয়ার কানে পৌঁছে গেছে। রহমত মিয়ার বয়স ত্রিশ, এক নম্বরের ধুরন্ধর ছেলে। চারবছর হলো সে আহসান ভিলায় এসেছে কিন্তু এর মধ্যেই সে এ বাড়িতে তার রাজত্ব বসিয়ে ফেলেছে। রহমত মিয়াকে এ বাড়ির কর্তী সাহানা আহসান ছাড়া আর কেউই পছন্দ করে না। রহমত মিয়া এখন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। এই সিগারেটটা সে কিনেছে বাজারের বেঁচে যাওয়া টাকা থেকে। বাজার করার পর একশো টাকা বেঁচে গিয়েছিল, তাই রহমত মিয়া বড়ই চালাকির সাথে সবকিছুর হিসাব মিলিয়ে দিয়েছে। রহমত মিয়ার হাতের সিগারেটটা প্রায় শেষ, আর এক টান দিয়েই রহমত মিয়া সিগারেটের শেষাংশটা ফেলে দিয়ে ছুটলো আহসান সাহেবের ঘরের দিকে। আহসান সাহেব এখনো কেশেই যাচ্ছেন, রহমত মিয়া ঘরে ঢুকেই টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা দ্রুত আহসান সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘খালু একটু পানি খান।’
আহসান সাহেব পানি খেয়ে কিছুটা শান্ত হলেন, কিছুক্ষণ ভালোভাবে দম নেওয়ার পর রহমত মিয়াকে বললেন, ‘তোকে না কতবার বলেছি, তুই আমাকে খালু বলবি না, স্যার বলবি। এক কথা তোকে কতবার বলা লাগে?’
রহমত মিয়া দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল, ‘ভুল হয়া গেসে খালু, থুক্কু সার। আসলে সার ব্যাপারডা হয়সে কি? খালাম্মারে, খালাম্মা কই তো, তাই ফিল কইরা আপনেরে বারবার খালু কইয়া ফেলাই। আর আরেকটা কতা কি জানেন সার, কতাডা শুনলে আপনি একদম তাজ্জব যাবেন। আপনের চেহার-সুরত পুরাই আমার আপন খালুজানের মতোন। তাই মনে করেন যে, আপনেরে দেখলেই আমার আপন খালুজানের কতা মনে পইরা যায়, তহনই মুখ থেইকা “খালু” ডাক বাইর হয়া যায়। এইডা কি আমার দোষ…’
আহসান সাহেব এবার রহমত মিয়াকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘খবরদার রহমত, তুই তোর এসব আজগুবি গল্প আমাকে একদম শোনাবি না। ফাজিল কোথাকার। তোর এসব আজগুবি গল্প, তুই তোর খালাম্মাকে গিয়ে শোনা। তার তো মাথা মোটা, সেই শুনবে তোর এইসব আজগুবি গল্প। তুই যে এসব বলে বলেই সাহানার মাথা খাস তা আমি ভালো করেই জানি।’
রহমত মিয়া কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘এইডা একটা কতা কইলেন সার, মনে বড়ই দুঃখ পাইলাম। হ মানলাম, খালাম্মা আমারে বিশেষ সেনেহো করেন দেইখা আমিও খালাম্মারে বিশেষ সম্মান করি। তয় মাথা খাওয়োনের কতা এহেনে ক্যান আসতেসে খালু, থুক্কু সার। আপনের কতা শুইনা বড়ই দুঃখ পাইলাম সার।’
আহসান সাহেব নরম গলায় বললেন, ‘আচ্ছা হয়েছে, হয়েছে আর নেকামি করতে হবে না। তোর খালাম্মাকে আবার এইসব কথা বলিস না, যা।’
– সার আপনের কি তাই মনে হয় যে, ‘আমি সব কতায় খালাম্মারে গিয়া কই, এইডাও কিন্তু আপনের ভুল ধারণা। এই যে আপনে এহন আমারে দুঃখ দিয়া একটা কতা কইলেন, আপনের কি মনে হয়? আমি এইডা খালাম্মারে কমু, না, আমি কমু না। আবার, এই যে ধরেন একটু আগে আপনে আমারে ফাজিল বইলা গালি দিলেন, আপনের কি মনে হয়? আমি এইডাও খালাম্মারে গিয়া কমু, না সার না, আমি কমু না। আপনে মুরব্বি মানুষ, দোষ দেখলে তো শাসন করবেনই। শাসন করতে গিয়া শুধু গালি ক্যান? আপনে যদি আমারে আপনের পায়ের জুতা খুইলাও মারেন, আমি তাও পিঠ পাইতা দিমু। চুপ থাকোনের কারণডা কি জানেন সার? কারণডা হইলো, আপনে আমার অন্নদাতা। আমি আপনের নুন খাইসি আর যার নুন একবার আমি খাইসি, তার শুধু গালি ক্যান? জুতার বাড়ি খাইতেও আমার মিষ্টি লাগবো।’
আহসান সাহেব এতক্ষণ কড়া দৃষ্টিতে রহমত মিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, রহমতের দীর্ঘ বক্তব্যের পর এবার তিনি মুখ খুললেন, ‘তুই এখানে কি করছিস রহমত? তোর জায়গা তো এটা না।’
রহমত মিয়া তার পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘ক্যান খালু থুক্কু সার?’
– তুই যে বড় মাপের অভিনেতা, যেভাবে তুই এক নিঃশ্বাসে এত লম্বা-চওড়া ডায়লগ বলে যাচ্ছিস, সে হিসেবে তো মনে হচ্ছে তোকে সিনেমায় যাওয়া উচিত। ভংচং তো ভালোয় ধরতে পারিস, সিনেমায় গেলে ভালোই নাম কামাবি।
রহমত মিয়া বোধ হয় আহসান সাহেবের কথার সার্কাজমটা ধরতে পারেনি, তাই সে লজ্জা পেয়ে
বলল, ‘কি যে বলেন না সার, আমি কি আর সিনেমার হিরোর লাহান সুন্দর? আমার তো হিরো হওয়া হয়বো না।’
আহসান সাহেব বুঝলেন রহমতের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, তাই কথা ঘুরিয়ে বললেন, ‘তুই না বাজারে গিয়েছিলি?’
– হ সার, গেসিলাম তো। তয় চইলা আইসি একটু আগেই।
– ওহ, ঠিকাছে। যা, রহিমের মাকে গিয়ে বল, আমাকে এক কাপ চা দিতে।
– জে আচ্ছা খালু, থুক্কু সার।
রহমত মিয়া আহসান সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে রহিমের মাকে এক কাপ চা দিতে বলে রওনা হলো এ বাড়ীর কর্তী সাহানা আহসানের ঘরের দিকে। গত কয়েকদিন ধরে আহসান সাহেব আর তার স্ত্রী সাহানা আহসানের মাঝে কোল্ড ওয়ার চলছে। বুড়ো দম্পতির এই ঝগড়াঝাটি অতি তুচ্ছ কারণে দুদিন পরপরই শুরু হয়। এবারের ঝগড়াটাও লেগেছে অতি তুচ্ছ কারণে, “গুড মর্নিং” নামক এই পাঁচ অক্ষরের শব্দটা থেকে। গত রবিবারের কথা, সেদিন সকালে আহসান সাহেব চায়ের টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন আর তার সাথে খুকখুক করে কাশছিলেন। একটু পরে নিজের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মিসেস আহসান হাজির হলেন চায়ের টেবিলে, আহসান সাহেবের পাশের চেয়ারে বসলেন আয়েশ করে। মিসেস আহসান চেয়ারে বসেই আহসান সাহেবকে বললেন, ‘গুড মর্নিং।’
আহসান সাহেব জবাবে শুধু জোরে জোরে কাশলেন, কাশি চলল পাঁচ মিনিট মতো, তারপর সব নীরব। মিসেস আহসান বেশ কিছুক্ষণ ধরে আহসান সাহেবকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘আমি যে তোমাকে গুড মর্ণিং বলেছি, তুমি এটা শোননি।’
আহসান সাহেব খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘বলেছো নাকি? ওহ সরি, খবরের কাগজ পড়ছিলাম তো তাই খেয়াল করিনি।’
মিসেস আহসানের মুখ মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল, তিনি কঠিন করে বললেন, ‘আহসান, তুমি কি এখনও সিগারেট খাও?’
– রোজ খাই না।
– শেষ কবে খেয়েছো?
আহসান সাহেব একটু ভেবে নিয়ে
বললেন, ‘এই তো কয়েকদিন আগে, রুমানার সাথে যেদিন রাস্তায় দেখা হলো সেদিন।’
কথাটা বলেই আহসান সাহেব বুঝলেন তিনি ভুল কথা ভুল জায়গায় বলে ফেলেছেন। রুমানা ছিল আহসান সাহেবের কলেজ লাইফের এক্স গার্লফ্রেন্ড, তার সাথে যে আহসান সাহেবের এখনো যোগাযোগ আছে এটা নিয়ে মিসেস আহসান এমনিতেই সন্দেহ করেন এবং মাঝে-মাঝে জেরাও করেন কিন্তু আহসান সাহেব কোনোদিনই ধরা দেননি। মিসেস আহসান শীতল গলায় বললেন, ‘ওহ, রুমানা তাহলে রাস্তা-ঘাটে পুরনো প্রেমিককে সিগারেট ফোঁকায়।’
আহসান সাহেব কৈফিয়ত দেওয়ার ভান করে বললেন, ‘আহা সাহানা, তুমি যেরকম ভাবছো ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। সেদিন হঠাৎই…’
– বলতে হবে না, আমি সবই বুঝেছি। আমিও তো বলি হঠাৎ কাশি শুরু হলো কেন? তা তোমার রুমানা কি তোমাকে গঞ্জিকাও সেবন করতে বলেছে? এবার কি তুমি তার জন্য গাঁজাখোর হবে?
একথা মিসেস আহসান আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ঘরে চলে এসেছিলেন। তারপর আর কি? চলছে কোল্ড ওয়ার।
রহমত মিয়া ঘরে ঢুকেই দেখলো, মিসেস আহসান বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। রহমত মিয়া মিসেস আহসানের পায়ের কাছে বসে বলল, ‘স্লামালাইকুম খালাম্মা, সকালে খাইসেন আপনি?’
মিসেস আহসান বিছানায় বসে সমরেশ মজুমদার এর কালজয়ী উপন্যাস “সাতকাহন” এর দ্বিতীয় খন্ড পড়ছিলেন। এই বইটা ওনার প্রায় মুখস্থ কিন্তু তারপরও আহসান সাহেবের সাথে ঝগড়া হলেই, তিনি এই বইটায় পড়েন। ওনার ধারণা এতে নাকি মনোবল বাড়ে। রহমতের উপস্থিতি টের পেয়ে মিসেস আহসান বইটা পাশে রেখে বললেন,‘ওয়ালাইকুমুস সালাম, খেয়েছি আমি। তুই খেয়েছিস?’
– জে খালাম্মা, খাইসি।
– কি রে তোর মুখ এরকম শুকনো লাগছে কেন? তিথির বাবা তোকে কিছু বলেছি নাকি?
রহমত মিয়া হাত কচলাতে-কচলাতে নিচু গলায় বলল, ‘না ওই এমনেই, উনি তো মুরব্বি মানুষ। আমারে একটু শাসন করতেসিলেন আর কি…’
মিসেস আহসান বললেন, ‘ওর শাসন আমি ভালো করেই জানি, তুই ওর কথায় কান দিস না। আচ্ছা ভালো কথা, তোকে যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটা হয়েছে?’
রহমত মিয়া আবার তার লালচে দাঁত বের করে হেসে উঠে বলল, ‘এই রহমতরে হুকুম করসেন আর কাম হইবো না, এইডা কহনো হইসে খালাম্মা? হয় নাই। নিয়া আইসি পাক্কা খবর।’
মিসেস আহসান অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন গোপন খবরটি জানার জন্য।
রহমত মিয়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খালাম্মা, এক্কেরে পাকা খবর আছে। তিথি আফা এক ফকিন্নির পোলার লগে মেলামেশা করে। কইতে শরম লাগতেসে, তাও কই খালাম্মা, তিথি আফায় ওই বেডার ম্যাসে গিয়া রান্না-বান্নাও কইরা দিয়া আসে। এহন বুঝেন তাইলে পানি কতদূর গড়াইসে।’
মিসেস আহসান বিছানার সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে তিনটা একশো টাকার নোট রহমতের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নে তোর বখশিশ আর শোন, তিথি বাইরে গেলেই তুই একদম ছায়ার মতো পিছু করবি আর উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই সোজা আমায় ফোন দিবি।’
রহমত টাকাগুলো শার্টের পকেটে রেখে বলল,‘জে আচ্ছা খালাম্মা। টাকাগুলা আপনে ভালোবাইসা দিলেন তাই নিলাম। তা না হইলে রহমত এই টাকা ছুঁয়্যাও দেখতো না। আসি খালাম্মা, স্লামালাইকুম।’
রহমত মিয়া মিসেস আহসানের ঘর থেকে বের হয়েই বড়সড় ধাক্কা খেল। মিসেস আহসানের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তিথি। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে ঘরের ভেতরের সব কথায় শুনেছে। রহমত মিয়া এ বাড়িতে শুধু একজনকেই ভয় করে আর সেটা হলো আহসান সাহেবের একমাত্র মেয়ে তিথি। তিথির বয়স আনুমানিক চব্বিশ, সে তার কলেজের বেকার সিনিয়র, রাশেদকে ভালোবাসে এবং বেশ কয়েকমাস ধরেই তাদের প্রেমের সম্পর্ক গাঢ়তর হয়েছে। তিথি রহমতকে তার ঘরে আসতে বলে নিজের ঘরে রওনা হলো। রহমত মিয়া বিপদের দোয়া পড়তে-পড়তে তিথির ঘরে ঢুকে বলল, ‘স্লামালাইকুম আফা, আমারে তলব করসেন ক্যান তা কি জানতে পারি?’
তিথি শান্ত গলায় বলল, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম, অবশ্যই জানতে পারো। জানাবো বলেই তো ডাকলাম। আচ্ছা, রহমত ভাই একটা কথা বলো তো, তুমি গোয়েন্দাগিরি কবে থেকে শুরু করলে?’
রহমত মিয়া ভয়ের দাপটে দাঁড়ানো থেকে মেঝেতে বসে গেল, তারপর ঢোক গিলে
বলল, ‘আফা, আমি কিছু নিজের ইচ্ছায় করি নাই। আমারে খালাম্মা আদেশ দিসিলো তাই করসি। মাফ কইরা দ্যান আফা।’
– মাফ তো করবই তবে মাফের বদলে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
– হুকুম করেন আফা, বান্দা সবেতেই হাজির।
– মা তোমাকে কত দিয়েছে?
– তিনশো দিসে আফা।
তিথি তার পার্স থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট রহমত মিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তিনশো টাকা মুখ বন্ধ রাখার জন্য আর বাকি দুইশো টাকা আমার বিয়েতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। আজ বিকালে আমি আর রাশেদ কাজী অফিসে বিয়ে করবো। আমার একজন সাক্ষী কম পড়েছে, তুমি বিকালে কাজী অফিসে যাবে আমার তরফ থেকে সাক্ষী দিতে। বুঝেছো? নাও টাকাটা।’
রহমত মিয়া ওমনি একহাত দিয়ে কান ধরে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘না আফা, এইডা আমি নিতে পারুম না। আপনে হইলেন আমার বইনের মতোন, বইনের বিয়া-ই সাক্ষী দিমু, তার আবার টাকা কিসের? নিমু না আফা টাকা।’
তিথি স্থিরদৃষ্টিতে রহমতের দিকে তাকিয়ে বলল,‘রহমত ভাই নাটক করো না তো, নাও ধরো।’
রহমত প্রতিবাদ করে বলল, ‘আফা এইডা একটা কতা কইলেম, আমি কি সিনেমার হিরো যে, নাটক করুম। এইডা আপনে কইতে পারলেন আফা।’
তিথি মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ভালোবেসে দিচ্ছি, এবার তো নাও।’
রহমত মিয়া এবার পাঁচশো টাকার নোটটা শার্টের পকেটে রেখে বলল, ‘ভালোবাইসা দিলেন বইলা নিলাম, তা না হইলে রহমত এই টাকা ছুঁয়্যাও দেখতো না।’
– বিকাল পাঁচটায় সময় মতো পৌছে যাবে কাজী অফিসে, না হলে কিন্তু…
– বুঝছি আফা, কওন লাগতো না। এই রহমত মিয়া কতার খেলাম করে না। এক্কেরে টাইমে পৌছাইয়া যামুনে, আপনে কিস্সু চিন্তা কইরেন না।
রহমতকে বিদায় দিয়ে তিথি রওনা হলো তার বাবার কাছে। আহসান সাহেব আবারও কাশতে শুরু করেছেন। তিথি ঘরে ঢুকেই আহসান সাহেবকে বলল, ‘বাবা, তোমাকে না বললাম শফিক চাচার চেম্বারে যেতে। কয়েকদিন ধরে কেশেই যাচ্ছো, ভালোভাবে চেকআপ করাটা তো জরুরি।’
আহসান সাহেব মেয়ের কথায় দাবার ঘর থেকে মুখ তুলে তাকালেন, তিনি আজকাল একা-একা দাবা খেলেন। মেয়ের কথার জবাবে তিনি বললেন, ‘গিয়েছিলাম রে মা, কফ পরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছি। শফিক কিছু ওষুধপত্র দিয়েছে, সেগুলো খাচ্ছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।’
– তুমি বোধ হয় আবার সিগারেট খেয়েছিলে তাই না? বাবা তোমার না এ্যাজমা আছে, সিগারেট কেন খেয়েছো?
– ওসব বাদ দে মা। তুই বল, ভার্সিটি যাসনি আজ?
– আজ যায়নি, বাইরে কিছু কাজ আছে। সেই কাজ নিয়েই কথা বলতে আসলাম।
– কাজ? কি কাজ? বল কি বলবি।
– আমাকে দশ হাজার টাকা দাও।
– দশ হাজার টাকা? কেন?
– আজ আমার বিয়ে তাই।
– বিয়ে মানে?
– বিয়ে মানে বিয়ে বাবা। আজ বিকালে আমি আর রাশেদ কাজী অফিসে বিয়ে করবো, তাই আমার টাকাটা দরকার। এখন দাও, তোমাকে পরে শোধ করে দেবো।
আহসান সাহেব ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কি রে মা, তোর কি শরীর খারাপ নাকি? কিসব বলছিস?’
তিথির চোখে হঠাৎই পানি জমলো, সে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল, ‘বাবা আমি ঠিক আছি। রাশেদকে আমি ভালোবাসি বাবা, ও খুব ভালো ছেলে, খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট। সুযোগ-সুবিধা পেলে ও অনেক নাম করবে কিন্তু রাশেদ এতিম বলে, মা কখনোই ওকে মেনে নেবে না। তাই মাকে না জানিয়েই, আমরা আজকে বিয়ে করে ফেলবো। বিয়ে একবার হয়ে গেলে মা আর কিছু বলতে পারবে না।’
আহসান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, চোখ মুছে দিলেন।
তারপর নরম গলায় বললেন, ‘মা রে, তুই আমার একমাত্র মেয়ে আর তুই কি না কাজী অফিসে বিয়ে করবি? এটা আমি কিভাবে সহ্য করবো রে মা। তুই চল আমার সাথে, আমি কথা বলবো তোর মায়ের সাথে। রাজি হবে না মানে? রাশেদের সঙ্গেই তোর ধুমধাম করে বিয়ে হবে, আমি দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেবো। তুই চল।’
তিথি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘না বাবা, ওসবের দরকার নেই। মায়ের সাথে এমনিই তোমার কোল্ড ওয়ার চলছে, এখন এসব কথা তুললে, হিতে বিপরীত হবে। আর তোমার মন খারাপ করার কোনো দরকার নেই, বিয়ে যে ধুমধাম করেই হতে হবে তার কোনো মানে আছে নাকি? আমি কাজী অফিসে বিয়ে করবো, এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে। তুমি টাকাটা দাও।’
আহসান সাহেব লকার থেকে পনেরো হাজার টাকা বের করে তিথির হাতে দিয়ে বললেন,‘আমাকে তোর বিয়েতে দাওয়াত দিবি না?’
তিথি টাকা গুনতে-গুনতে বলল, ‘না আমি তো পালিয়ে বিয়ে করছি, পালিয়ে বিয়ে করলে বাবা-মা বিয়েতে উপস্থিত থাকে নাকি? থাকে না। তাই তুমিও আমার বিয়েতে আমন্ত্রিত নও। তবে হ্যাঁ, ফেরার পথে আমি তোমার জন্যা তেহারি আর কোক নিয়ে আসবো, আমার বিয়ের ট্রিট হিসেবে।’
তিথি টাকা গুনে বলল, ‘বাবা আমি তো দশ হাজার চেয়েছি, পনেরো হাজার দিলে কেন?’
আহসান সাহেবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, আদুরে গলায় বললেন, ‘বাকি পাঁচ হাজার, আমার তরফ থেকে তোর বিয়ের উপহার।’
তিথি মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমি আসি তাহলে। রাশেদকে নিয়ে বিয়ের বাজার করতে যাবো।’
তিথি চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেই রহমত মিয়া হাজির হলো আহসান সাহেবের ঘরে। আহসান সাহেবের কাশি এখনো আগের মতোই আছে। আধঘন্টা পরপর উনি কেশে উঠছেন, তারপর আধঘন্টা আবার সবকিছু নীরব। রহমত মিয়া আহসান সাহেবের ঘরে এসে দেখলো, তিনি একা-একা দাবা খেলছেন। আহসান সাহেবের একা-একা দাবা খেলার ব্যাপারটা দেখে রহমত মিয়া খুব মজা পায়, সে মনে মনে ভাবে, ‘সারের মাথা এক্কেরেই গেসে গা।’
সে এখনও তাই ভাবছে, তার ভাবনায় ছেদ পড়লো আহসান সাহেবের বিকট কাশির শব্দে। রহমত মিয়া এবার আহসান সাহেবের সামনের চেয়ারটায় বসে বলল, ‘সার যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কতা কই?’
আহসান সাহেবের কাশির তোপ কিছুটা কমলো, তিনি চেসবোর্ড থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, ‘যখন ভাবছিস আমি মাইন্ড করবো, তাহলে বলার কি দরকার?’
রহমত মিয়া এবার তার কাঁধে রাখা লাল-সবজে রঙের গামছায়, তার অাঙুলে লেগে থাকা চুন মুছতে মুছতে আহ্লাদ করে বলল, ‘ওইডা সার এমনেই কইলাম আর কি। আমি তো জানি আপনে মনে কিছু নিবেন না। কতাডা হইলো, সার আপনে একা-একা দাবা খেলেন ক্যান? মানুষের অভাব হইলে এই রহমতরে শিখাইয়া দ্যান, রহমত দাবা খেলবো আপনের লগে।’
আহসান সাহেব এবার রহমত মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাজে না বকে, কি বলতে এসেছিস তাই বল।’
রহমত মিয়ার মুখে হাসি দেখা গেল, সে একটু শব্দ করে হেসে বলল, ‘খালু থুক্কু সার, আপনে ঠিকই আমার মনের কতাডা বুইঝা যান। তাইলে আসল কতাডা কইয়াই ফেলাই। সার আমার কতাগুলা একটু বেশিই মন দিয়া শুনবেন। আপনে যে কয়দিন ধইরা কাশতাসেন, ওষুধপত্র খাইয়াও তো কোনো লাব হচ্সে না। আপনের কাশি বন্ধ করবার ওষুধ কিন্তু আমার ওস্তাদের কাছে আছে, আপনে চাইলে আমি আমার ওস্তাদের ঠিকানা আপনেরে দিমু।’
আহসান সাহেবের কপালে ভাঁজ দেখা গেল, তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কি এমন ওষুধ? ঝেড়ে কাশ তো।’
রহমত মিয়া ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খুব ইস্পেশাল ওষুধ সার, এক চিপি খাইলেই আপনের কাশি উধাও। যদিও ওষুধটা খুব গোপন, তারপরেও আপনে আমার অন্নদাতা, আপনেরে তো আমি এমন কষ্টে দেখতে চাই না।’
– তুই এমন ফিসফিস করছিস কেন? কি এমন গোপন ওষুধ?
রহমত মিয়া আগের চেয়েও নিচুস্বরে বলল, ‘সার, ওইডা একসময় কাশির ওষুধই আছিলো, তয় এহন নেশা হয়া গেসে। ওইডার নাম হইলো ডাইল।’
আহসান সাহেব সন্দেহ নিয়ে বললেন, ‘ডাইল মানে?’
রহমত সাফাই গেয়ে বলল, ‘আরে সার, আপনে তো দেহি কিছুই জানেন না। ওইডার একটা আলাদা নাম আছে, তয় অনেকেই ভালেবাইসা ডাইল কয়।’
আহসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো সেই আলাদা নামটা কি?’
রহমত মিয়া নিচু গলায় বলল, ‘ফেনসিডিল।’
আহসান সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই বেয়াদব, তোর কি আমাকে নেশাখোর মনে হয়? আমি ফেনসিডিল খাবো কেন? তুই জানিস না ওটা নেশা জাতীয় দ্রব্য।’
রহমত মিয়া এবার স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘সার এক চিপি খাইলে কিস্সু হয় না। আমি ওস্তাদের লগে পরামর্শ করসি, উনি বলসেন আপনেরে নিয়া যাইতে। আল্লাহর নাম নিয়া এক চিপি খাওয়াই দিলেই আপনার কাশি উধাও হইয়া যাইবো।’
আহসান সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে রহমত আবার বলল, ‘সার ভয় পাইয়েন না, এক চিপি খাইলে কিস্সু হয় না। আমার এক দোস্তের ওরকম আপনের মতো মরণ কাশি হইসিলো। সেই কাশি সার, ওষুধ খাইয়া কোনো লাব হয় না। বেচারা কাশির ঠেলায় ভাত খাইতেও পারতো না। তারপর আমি উপায় না দেইখা, ওরে ওস্তাদের কাছে নিয়া গেসিলাম। ওস্তাদ তহন ওরে এক চিপি ডাইল খাওয়াইয়া দিসিলো, তারপর আর কি, জাদুর মতন ওর কাশি উধাও হয়া গেল।’
আহসান সাহেব রহমতের কথায় কিছুটা আস্বস্ত হলেন, তিনি বললেন, ‘ভালো হবে বলছিস?’
– হানডেট পাস্সেন্ট গ্যারান্টি সার, ভালো হইবো ইনশাআল্লাহ।
– তাহলে ঠিক আছে, মানলাম তোর কথা। নিয়ে চল তোর ওস্তাদের কাছে।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়েছে, এমন ভান করে রহমত মিয়া বলল, ‘সার আমি তো আজকে আপনের সাথে যাইতে পারুম না, একটা জরুরি কাজ আছে। তয়, আপনে চিন্তা কইরেন না,আমি একটা চিঠি লেইখা দিমুনে আর ঠিকানা দিমুনে। আপনে সেই ঠিকানায় গিয়া বলবেন, আমারে রহমত পাঠাইসে। তাইলেই দেখবেন কাম হয়া গেসে।’
আহসান সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা দে ঠিকানা।’
রহমত মিয়া তখনই তার শার্টের পকেট থেকে দুইটা চিরকুট আহসান সাহেবের হাতে দিয়ে
বলল, ‘বিকাল পাঁচটার দিকে চইলা যায়েন, ইনশাআল্লাহ কাম হয়া যাইবো।’
আহসান সাহেব চিরকুট দুটো পাঞ্জাবির পকেটে রেখে বললেন, ‘চিঠি আর চিরকুট তো রেডি করেই রেখেছিলি দেখছি, তার মানে তুই আগে থেকেই জানতি, যে আমি যেতে রাজি হবো।’
রহমত মিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে বলল, ‘সার এইডা কোনো বড় কতা না। সবাই সুস্থ থাকবার চাই, কেউ কি আর অসুস্থ থাকবার চাই? তাই ভাবসিলাম, আপনি রাজি হবেন।’
আহসান সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি তোকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম, তুই তার থেকেও বেশি চালাক।’
উত্তরে রহমত মিয়া তার পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে সরলভাবে হাসলো। তারপর বলল,‘আসি সার, আপনে সময় মতো চইলা যায়েন।’
—
এদিকে তিথি তার বিয়ের সমস্ত বাজার একা-একাই করেছে, রাশেদের একটা পরীক্ষা ছিল বলে সে তিথির সাথে আসতে পারেনি। তিথি যখন সবকিছু কেনাকাটা করে রাশেদের মেস বাড়িতে পৌছলো, তখন দুপুর দেড়টা বাজে। তিথি মেসে পৌঁছে দেখে, রাশেদ চোখে চশমা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তিথি এগিয়ে গিয়ে রাশেদের চোখ থেকে চশমাটা খুলতেই, রাশেদ চোখ মেলে তাকালো, তারপর মুচকি হেসে বলল, ‘কখন এলে?’
– এই তো এখনি। তোমার কি অবস্থা? পরীক্ষা কেমন দিলে?
রাশেদ শোয়া থেকে উঠে বসে বলল, ‘ভালো হয়েছে পরীক্ষা, চাকরিটা বোধ হয় হয়ে যাবে।’
তিথি আনন্দের সাথে বলল, ‘তাই? তাহলে তো খুবই ভালো হবে।’
রাশেদ সায় মিলিয়ে বলল, ‘অনেক ভালো হবে। আমার জয়েনিং লেটার আসলে আমি কি করবো জানো?’
তিথি আগ্রহের সাথে বলল, ‘জানি না, কি করবে?’
রাশেদ হাত দিয়ে টেলিফোন ধরার ভঙ্গি করে গানের সুরে বলল, “চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি তিথি শুনছো? এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না।
সমন্ধটা এই বার তুমি প্রকাশ করতে পারো, মাকে বলে দাও অন্য কোথাও বিয়ে তুমি করছো না।
চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি তিথি সত্যি, আর মাত্র কয়েকটা দিন ব্যাস। স্ট্রার্টিং-এই ওরা পনেরো দেবে, তিনমাস পরে কনফার্ম।
চুপ করে কেন? তিথি কিছু বলছো না।
এটা কি 013**2325? তিথি আহসান পাচ্ছো কি শুনতে?
দশ-বারো বার হারাতে-হারাতে ফিরে পেয়েছি তোমাকে, দেবো না কিছুতেই আর হারাতে।
হ্যালো! 013**2325? দিন না ডেকে তিথিকে একটিবার।
ব্যালেন্স কাটছে আমার এই সস্তা মুঠোফোনের, জরুরি খুব জরুরি দরকার।
দিননা ডেকে একটু, ওকে বলি আমি আবার, চাকরিটা এবার সত্যি পেয়েছি, চিন্তা করার দরকার নেই আর।”
তিথির গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সে ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আর একটিবার গাইবে? আমি ফোনে রেকর্ড করে রাখি।’
রাশেদ রুমাল দিয়ে তিথির চোখ মুছে দিয়ে বলল, ‘উহু, এটা করা যাবে না, বারবার শুনলে ভালো লাগা চলে যাবে। জয়েনিং লেটার এলে আবার শোনাবো।’
তিথি কিছু মনে পড়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘তুমি তো খাওনি না? দেখছো, তোমার গানের চক্করে আমি খাবার বাড়তে ভুলে গেছি। আমি খাবার নিয়ে এসেছি, এসো খেয়ে নাও।’
– হুম, এসো দুজনে একসাথে খাই।
—
বিকেলবেলা আহসান সাহেব উপস্থিত হয়েছেন, রহমতের দেওয়া ঠিকানায়। আহসান সাহেব এখন যেখানে বসে আছেন, সেই জায়গাটা অনেকটা বস্তির মতো। এখানে আসার পর থেকে আহসান সাহেবের কাশিটা হঠাৎই কমলো কিভাবে? এটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না, তিনি তো এখনও ডাইল খাননি তবে কমলো কিভাবে? রহমত বলেছিল, তার ওস্তাদের অনেক ক্ষমতা, তাহলে কি তার ওস্তাদের উপস্থিতিতেই আহসান সাহেবের কাশি কমে গেল?
এতসব প্রশ্নের উত্তর আহসান সাহেব জানেন না, তার কাশি কমেছে এতেই তিনি খুশি।
আহসান সাহেবের সামনের চেয়ারে একজন মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে, ইনিই রহমতের ওস্তাদ। ওস্তাদ লোকটির নাম জানতে পারেনি আহসান তবে লোকটাকে দেকে তার নেশাখোর মনে হচ্ছে, এখনও কেমন জানি ঝিম ধরে বসে আছেন। লোকটি এখন পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি, শুধু একবার ফ্যাসফেসে গলায় আহসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘জনাব আপনের সমস্যা কি?’
আহসান সাহেব উত্তরে বলেছেন, ‘প্রচন্ড শুকনা কাশি।’
লোকটি সন্দেহের সুরে বলেছে, ‘ম্যালাক্ষণ ধইরায় তো এহেনে বইসা আছেন কিন্তু কাশতে যে শুনলাম না একবারও।’
এর উত্তর আহসান সাহেব দিতে পারেননি, তিনি বিনীতভাবে বলেছেন, ‘ভাই, ওই জিনিসটা আমাকে একটু তাড়াতাড়ি দিন, অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে আসলো, বাসায় যেতে হবে।’
সেই তখন রহমতের ওস্তাদ, তার এক সাগরেদে ওই জিনিস আনতে পাঠিয়েছে কিন্তু সেই সাগরেদ এখনও কাঙ্ক্ষিত তরল নিয়ে পৌছলো না।
আহসান সাহেব ভাবলেন, ওস্তাদকে এই ব্যাপারে বলবেন, আর তখনই, আরেক সাগরেদ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো,তার চোখে-মুখে ভয়।
সাগরেদটি ঘরে ঢুকেই ওস্তাদের কানে ফিসফিস করে কি যেন বলল, আর তখনই ওস্তাদজী দড়াম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
তারপর ওস্তাদজী আহসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব আমগো আস্তানায় পুলিশ হামলা করসে, আপনি তাড়াতাড়ি পিছনের গলি দিয়া লুঙ্গি চাইরা দৌড় দ্যান।’
এটুকু বলেই ওস্তাদজী আর তার দলবল আস্তানা ছেড়ে পালালো। আহসান সাহেব ভয়ে শিটিয়ে গেছেন, অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে তিনিও পিছনের গলি দিয়ে পালালেন। তিনি রুদ্ধশ্বাসে ছুঠছেন আর তার পেছনে দুই-তিনটা পুলিশ কনস্টেবল তাড়া করছে, দৃশ্যটা খুবই হাস্যকর।
আহসান সাহেব এই বয়সেও খুব জোরে দৌড়াচ্ছেন, এটা দেখে তিনি নিজেই অবাক হলেন। তারপর তার মনে পড়লো, তিনি যুবক বয়সে দৌড় প্রতিযোগিতায় জেলা ভিত্তিক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
—
রহমত মিয়াকে কাজি সাহেব ধমক দিয়ে
বললেন, ‘এই মিয়া, এটা কি লিখেছেন? আপনার বাবার নাম কুদ্দুস বয়াতি।’
রহমত মিয়া তার লালচে দাঁত বের করে মুচকি হেসে বলল, ‘হ চাচা, আমার আব্বার নাম কুদ্দুস বয়াতি। আমার আব্বা আমগো গেরামের নামকরা গায়ক আছিল। আব্বাজানের গান শুইনা গেরামের সগ্গলে, তারে কুদ্দুস বয়াতি কইয়া ডাকতো। তহন থেইকায় আব্বার নাম হইয়া গেসে কুদ্দুস বয়াতি।’
কাজি সাহেব রহমতের দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ফাইজলামি করাী জায়গা এইটা? এখানে শুধু কুদ্দুস লিখেন, বয়াতি কেটে দিন।’
রহমত মিয়া প্রতিবাদ করে বলল, ‘এইডা কোনো কইলেন চাচা, আমার আব্বার নামডা আপনে ক্যান ছোট কইরা দিবেন?’
কাজী সাহেব এবার ধমকের সুরে বললেন, ‘ধুর মিয়া, আপনি আমাকে চাচা বলছেন কেন? আজব তো, আমি কি আপনার চাচা লাগি? আমাকে কাজি সাহেব বলবেন, চাচা না আর যেটা বলছি সেটা লিখেন।’
– না চাচা থুক্ক কাজি সাহেব, আমি এইডা করতে পারুম না।
রহমত মিয়া এবার বেঁকে বসলো, তার বাবার নাম সে কিছুতেই ছোট করবে না।
তিথি এতক্ষণ চুপচাপ রহমতের কান্ড দেখছিল, সে এবার মুখ খুললো, ‘রহমত ভাই তোমার নাটক বন্ধ করবা? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি, চুপচাপ কাজি সাহেব যা বলছেন তাই লিখে দাও।’
রহমত মিয়া কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘আফা আপনে এইডা বলতে পারলেন? আমি নাটক করতাসি? মনে খুব কষ্ট পাইলাম আফা।’
তিথি শীতল গলায় বলল, ‘রহমত ভাই..’
রহমত এবার ভয় পেয়েছে, সে হাতে কলম তুলে নিয়ে বলল, ‘আইচ্ছা আফা, লিখতাসি।’
রহমত মিয়া নাম লেখার পর, কাজি সাহেব ‘তিন কবুল’ পড়িয়ে তিথি আর রাশেদের বিয়ে সম্পন্ন করলেন।
—
এদিকে আহসান সাহেব পূর্বের দৌড় অভিজ্ঞতার বদৌলতে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এখন তার ঘরের বিছানায় শুয়ে হাঁপাচ্ছেন। এই বয়সে এতো খাটুনি, তার শরীর নিতে পারছে না। তিনি রহমের ওস্তাদের কাছ থেকে সেই নিষিদ্ধ পানীয় পান করেনি কিন্তু তারপরও আহসান সাহেব লক্ষ্য করছেন, বিগত কয়েক ঘন্টা তিনি একবারও কাশেন নি। হঠাৎ কোন জাদুবলে কাশি ভালো হয়ে গেল? এটা আহসান সাহেব বুঝতে পারছেন না।
মিসেস আহসানের কান্নার আওয়াজ, আহসান সাহেব শুনতে পাচ্ছেন। মিসেস আহসান বিলাপ করছেন বলে মনে হচ্ছে কিন্তু কি হয়েছে? এটা বুঝতে পারছেন না আহসান সাহেব।
আহসান সাহেব ঘটনা বৃত্তান্ত কি? তা জানার জন্য রহমতকে ডাকতে যাবেন, এমন সময়ে রহমত মিয়া খোদ শরবত হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, ‘স্লামালাইকুম খালু থুক্কু সার, আপনের জন্যি শরবত নিয়া আসলাম। এক ঢোকে খায়া শেষ করেন, দেখবেন শরীর চাঙ্গা হইয়া যাইবো।’
আহসান সাহেব শরবতটা খেয়ে নিলেন, রহমত আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘সার ঘটনা কি? আপনে ধুকাইতেসেন ক্যান?’
ঠান্ডা শরবত খেয়ে আহসান সাহেব কিছুটা ধাতস্থ হলেন, তিনি রহমতকে বিকেলের ব্যাপারটা বলতেই রহমত মিয়া গর্জে উঠে বলল, ‘হায় হায় হায়, ওই খান** থুক্কু, ওই বেয়াদবের পোলায় আপনেরে পুলিশের দাবড় খাওয়াইসে, ছি ছি। খালু থুক্কু সার, আপনে মনে কিছু নিয়েন না, ওই বেডারে আমি দেখতাসি।’
আহসান সাহেব মুচকি হেসে বললেন, ‘বুঝলি রহমত, তোর ওস্তাদের ছোঁয়ায় আমার কাশি গায়েব হয়ে গেছে।’
কথাটা বলে আহসান সাহেব নিজেই শব্দ করে হাসলেন। রহমত মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘কন কি খালু থুক্কু সার?’
আহসান সাহেব রহমতের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শোন রহমত, তুই আমাকে এখন থেকে খালুই বলবি ঠিকাছে? কাশিটা যে কারণেই ভালো হোক কিন্তু আমার মতে, এর পেছনে তোর মুখ্য অবদান আছে। তুই এ কয়েকদিন আমাকে নিয়ম করে আদা চা, লবঙ্গ চা এইসব খাইয়েছিস। তাই আমি খুশি হয়ে, আমাকে খালু ডাকার অনুমতি দিলাম, এখন থেকে তুই আমাকে খালু বলেই ডাকবি।’
আহসান সাহেবের স্নেহে রহমত মিয়ার চোখে আজ সত্যিকার পানি এসেছে। অনেকদিন হয়ে গেল, সে এমন নির্ভেজাল স্নেহ পায়নি তাই সে নিজের কান্না আটকাতে পারছে না, নিঃশব্দে কাঁদছে। আহসান সাহেব রহমতকে আটকালেন না, কাঁদতে দিলেন।
মিসেস আহসানের ঝাঁঝালো গলা এখনও শোনা যাচ্ছে, আহসান সাহেব এবার রহমতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই রহমত, তোর খালাম্মার কি হয়েছে রে? এভাবে কার উপর চেঁচাচ্ছে?’
রহমত মিয়া চোখ মুছে বলল, ‘একটু আগে তিথি আফা আর রাশেদ দুলাভাই বিয়া কইরা আইসে, তাই খালাম্মা চেতসে। খালাম্মা বলতেসে, বিয়া মাইনা নিব না।’
রহমতের কথা শেষ হতেই তিথি আর রাশেদ ঘরে ঢুকলো। তারা আহসান সাহেবকে কদমবুসি করে সোফায় বসলো।
আহসান সাহেব রাশেদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার শাশুড়ি মায়ের কথায় কিছু মনে করো না বাবা, ও ওমনই। কদিন যেতে দাও ঠিক হয়ে যাবে।’
তিথি আহসান সাহেবকে বলল, ‘বাবা, আমরা কি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো?’
– ধুর পাগলি মেয়ে, তুই আমার একমাত্র মেয়ে, তোর বাড়ি ছেড়ে তুই কেন যাবি? তোর মায়ের কথায় কান দিস না, ওর সাথে তর্কও করিস না। বকবক করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে ও এমনিই থেমে যাবে। তোরা ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়, তোর মায়ের চিন্তা করিস না। ও যত গর্জে, তত বর্ষে না। কদিন যেতে দে, তোর মা-ই জামাইকে চোখে হারাবে। যা তোরা ঘরে যা।
রহমত মিয়া তিথিকে নিচু গলায় বলল, ‘আফা, একটা অনুরোধ আছিল।’
– বলো।
– আফা, আমি যে আপনের বিয়া-ই সাক্ষী দিসি, এইডা কিন্তু খালাম্মারে কইয়েন না। খালাম্মা জানতে পারলে, আমার চাকরি নট কইরা দিবে। আফা আপনে কইয়েন না পিলিজ।
তিথিসহ রাশেদ, আহসান সাহেব সবাই রহমতের কথায় হেসে উঠলো।
তিথি হাসি থামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা রহমত ভাই, ডিল ডান। আমি মাকে বলবো না, তুমি নিশ্চিতে থাকো।’
রহমত মিয়া এবার রাশেদকে বলল, ‘দুলাভাই, আপনেও কইয়েন কিন্তু।’
রাশেদ মুচকি হেসে বলল, ‘না রহমত ভাই, আমি বলবো না।’
আহসান সাহেব এবার নিজে থেকেই
বললেন, ‘আমিও বলবো না।’
রহমত মিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক, তার চাকরি নট হবে না।
তিথি আর রাশেদ আহসান সাহেবের ঘর ত্যাগ করতেই, ‘আহসান সাহেব রহমতকে বললেন, আমার খাবারটা ঘরেই দিয়ে যা রহমত। ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বো, না হলে, তোর খালাম্মার চিল্লানিতে থাকা যাবে না।’
– জি খালুজান আপনে ঘরেই থাকেন, আমি খাবার লইয়া আসতেসি।
—
রাত বাজে আড়াইটা, আহসান ভিলার সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু সবার ঘুমের আচ্ছন্নতা ভেঙে দিচ্ছে, মিসেস আহসানের ঝাঁঝালো গলার বিলাপ।