অবশেষে জলা জঙলের ধারে প্রত্যন্ত উপকূলীয় গ্রাম আনন্দপুরে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল।
মানুষের মুখে মুখে দাবানলের মত খবরটি ছড়িয়ে পড়ল।
গ্রামের দক্ষিন পাশের বড় ঝুড়ি বটগাছ ছাড়িয়ে একটু খানি এগিয়ে খালের ধারে গেলেই প্রাইমারী ইস্কুল। সেই প্রাইমারী ইস্কুলের সাথে একটি বড় নতুন পাকা বিল্ডিং উঠেছে। বিল্ডিংটি দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি ঠ্যাঙের উপরে। নীচতলা ফাঁকা। একটি চওড়া সিঁড়ি মাটি থেকে সোজা উঠে গেছে দোতলায়।
দূর সমূদ্র ঘেঁষা, জঙলে ঘেরা, আনন্দপুরের মানুষেরা বাপদাদার আমল থেকে শুরু করে কস্মিনকালেও এরকম ঠাংওয়ালা দালানের কথা শোনেনি।
এতদিন শুধুই হাঁ করে বিল্ডিংটির নির্মান কাজ দেখেছে আর মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছে।
আজই মাত্র হরিহর জলদাসের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মোহনলালের কাছে জানা গেল এটি নাকি প্রাইমারী ইস্কুল কাম ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র!
আর কয়দিন পরেই রাজ্যের মহামহিম মন্ত্রী মহাশয় সশরীরে এসে এই ‘ ইস্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্রের ‘ শুভ উদ্বোধন করবেন।!
গ্রামের হত দরিদ্র অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষদের মাঝে একধরনের কৌতুহল দেখা দিল।
বেশিরভাগ মানুষ ধীবর শ্রেণীর। উপকুলের কাছাকাছি সমূদ্রে ও নদীর মোহনায় সারাদিনমান মাছ ধরা শেষে সন্ধ্যায় তারা বাড়ি ফেরে।
সন্ধ্যার পরে হেমন্ত জলদাসের বৈঠকখানায় অনেকেই জড় হয়।
ঘর গেরস্থালী, ট্রলার নিয়ে মাছ ধরা, মহাজনের ঋনপান, ছেলে মেয়ের বিয়েশাদি এসবই আলোচনার বিষয় বস্তু।
আলোচনার নতুন বিষয় যোগ হয়েছে ‘ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ‘!
এর আগে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে অনেক বার আনন্দপুর গ্রামের অনেক মানুষ মারা গেছে, ঘর দরজা, গরু ছাগল, হাঁস মুর্গী ভেসে গেছে।
দুই বছর আগের জলোচ্ছ্বাসে হরেনের ছেলে নরেন জলদাস, রাজু দাসের বৃদ্ধা মা হরিদাসি, নয়ন বাগচির শিশু বাচ্চা, সেই যে ভেসে গেলো আজো তাদের খুঁজে পাওয়া যায় নাই।
ভবিষ্যতে যাতে কেউ জানে প্রানে মারা না পড়ে! তার জন্যই সদাশয় সরকার এই আশ্রয় কেন্দ্র বানিয়েছে!
একটি বিষয় তাদের মাথায় ঢোকে না – জলোচ্ছ্বাস যখন আসবে তখন নিজেরা ঐ ঠাংওয়ালা উঁচু আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে উঠলেও বাড়িঘর, গরু ছাগল,
হাঁস মুর্গি, ধান চাইলের কি ব্যবস্থা হবে!?
তারপরেও তারা এই ভেবে ভরসা পায় যে, নরেন জলদাসের মত চিরতরে ভেসে যেতে হবে না! সরকার বাহাদুরকে তারা মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানায়।
দিন দুইয়েক পরেই চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল।
বড় ঝুড়ি বটগাছের কাছে কাঁচা রাস্তাটি যেখানে ইস্কুলের দিকে মোড় নিয়েছে, সেইখানে বড় তোরণ নির্মান হতে লাগলো।
ইস্কুল কাম আশ্রয় কেন্দ্রের সামনে খোলা মাঠে বিশাল সামিয়ানা টানানো হতে লাগলো।
শহর থেকে নানান পদের নানান পোশাকের লোকজন আসতে লাগলো। আনন্দপুরের সুন শান কাঁচা রাস্তায়
হঠাৎ অচেনা শব্দ তুলে মোটর গাড়ির আনাগোনা শুরু হল।
কেউ কেউ মঞ্চ বানানোর তদারকি করতে লাগলো, কেউ কেউ গেট বানানো ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কর্মীদের সাথে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে লাগলো, কেউ কেউ ফিতা দিয়ে বার বার রাস্তার মাপ নিতে লাগলো এবং মন্ত্রী মশাইয়ের বড় মোটর গাড়ি এই রাস্তায় প্রবেশ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ পুর্বক মাথা দোলাতে লাগল।
শহরের লোকজনের সাথে সাথে স্থানীয় লোকজন
কে কি করবে, কে মন্ত্রী মশাইয়ের গুনগান সম্বলিত
মানপত্র পাঠ করবে, আনন্দপুরের বৃদ্ধ লোকদের মধ্যে হইতে কে বিগত আমলের ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ননাপুর্বক বক্তৃতা করবে, কে মহামহিম মন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন পুর্বক স্বাগত ভাষন দিবে, কে আনন্দপুর গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে তাদের নানাবিধ অভাব অভিযোগ পুরন করার দাবি উত্থাপন পুর্বক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিবে, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রাত দিন সমানে জল্পনা কল্পনা ও রিহার্সাল চলতে লাগলো।
খাল পাড়ের পর্ন কুটিরে বসবাসরত অন্ধ বসন্ত জলদাসের কানেও এ খবর পৌছে গেল।
বসন্ত জলদাস অনেককাল আগে গুটি বসন্তে ভুগে দুইটি চোখই অন্ধ হয়ে এখন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে।
বসন্ত জলদাসের আসল নাম ছিল কানুলাল জলদাস। কিন্তু বসন্ত হয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই বলাবলি করতো বসন্ত জলদাস,এভাবেই কানুলাল জলদাস একসময় বসন্ত জলদাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিল। বসন্ত জলদাসের নাই বলতে কেউই নাই কিংবা অন্ধ বসন্ত জলদাসকে একে একে সবাই ছেড়ে গেছে।
এহেন বসন্ত জলদাসের কানেও মন্ত্রী মশাইয়ের আগমনী বার্তা পৌছে গেল।
বসন্ত জলদাসের বুকের ভিতর এক ধরনের আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল।
প্রতিদিন অন্ধ বসন্ত – কুটিরের বাইরে এসে কোন দিন এবাড়ি ওবাড়ি থেকে ভাতের ফ্যানটুকু পায়, কোনদিন বা স্বব্যঞ্জন এক থালা ভাত জুটে যায়, তাই খেয়েই সারাদিন সে কুটিরে কাটিয়ে দেয়। কোন কোন দিন সন্ধ্যায় খালের ধারে বসে আপন মনে সে একতারা বাজিয়ে গান ধরে — ” দয়াল দিন যে গেল সন্ধ্যা হল পাড় কর আমারে.. দয়াল পাড় কর আমারে.. .. । ”
বসন্ত ভাবতে লাগলো – মহামহিম মন্ত্রী মশাইয়ের কাছে যদি একটিবার পৌছে গিয়ে তার অভাব অভিযোগ উত্থাপন করা যেত! তাহলে নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, তার অবস্থা বদলে যেতে পারে বৈকি!
অবশেষে সেই ইপ্সিত দিনের সূর্যোদয় ঘটল।
নিস্তরঙ্গ আনন্দপুর গ্রামের মানুষের মনে টান টান উত্তেজনা দেখা দিল।
মঞ্চের মাইক থেকে উদাত্তকন্ঠে ঘোষনা হতে লাগলো।
কারা কোথায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, যারা পুষ্প স্তবক প্রদান করবে তারা কোথায় অবস্থান করবে, রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে যারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষন করবে তারা রাস্তা থেকে কতটা দূরে দাঁড়াবে, ফুল যেন কোনক্রমেই গাড়ির কাঁচে না লাগে সে বিষয়ে বার বার সতর্কবাণী উচ্চারিত হতে লাগলো।
মহামহিম মন্ত্রী মশাইয়ের আগমনের সাথে সাথে কী ধরনের জয়ধ্বনি দেওয়া হবে তার রিহার্সাল চলতে লাগলো — ” মন্ত্রী মশাইয়ের আগমন, – শুভেচ্ছা স্বাগতম!!, ত্রান মন্ত্রীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম!!,
দুর্যোগ মন্ত্রীর আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম!! আনন্দ পুরের পক্ষ থেকে, লাল গোলাপ শুভেচ্ছা!!, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে, হাজারো মানুষের উদ্বেলিত আনন্দ উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল।
দূর থেকে দেখা গেল চারিদিকে ধূলা উড়িয়ে, দশ পনেরটি মোটর গাড়ির এক বিশাল বহর, হুইসেল বাজাতে বাজাতে, প্যাঁ পোঁ হর্ন বাজাতে বাজাতে, আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে আনন্দপুরের দিকে ছুটে আসছে।
গাড়ি বহর ঝুড়িবট তলার কাছাকাছি পৌছাতেই রাস্তায় দাঁড়ানো সারিবদ্ধ লোকেরা যাদের সুশৃঙ্খল ভাবে পুষ্পবৃষ্টি করার কথা ছিল তারা কেমন যেন তালগোল পাঁকিয়ে কেউ কেউ ভীরের চাপে রাস্তার উপরে ছিটকে পড়লো।
হঠাৎ মহামহিম মন্ত্রীর বিশালাকার গাড়ির নীচে কেমন যেন ফটাস শব্দ শোনা গেল!
গাড়ি বহরের সকল গাড়ি অতিক্রম করার পর দেখা গেল একটি ক্ষত বিক্ষত লাশ পড়ে আছে! মাথার খুলি ফেঁটে গিয়ে সকল ঘিলু ধূলার সাথে মিশে গেছে!
মানুষের মাঝে শোরগোল পড়ে গেল, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখা গেল এটা আর কেউ নয়! অন্ধ বসন্ত জলদাসের লাশ!!
সবাই সমস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো — “ও অন্ধ মানুষ! ও কেন বাড়ির বাহির হয়েছে? ও কেন বাহির হতে গেল!? ও’ কেন ঘরের বাহির হলো!