রমলা দেবী তার মাসতুতো বোন সোমার ছেলের বিয়েতে গিয়ে– মাসতুতো বোনেরই এক আত্মীয়ার মেয়ে –পর্ণা কে দেখে -তার একমাত্র ছেলে অর্ণবের পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করে ফেলেন—-
বিয়ের প্রস্তাবটা পর্নার বাবা-মায়ের কাছে রাখা হলে -ওনারা অবশ্য খুব খুশিই হন -আর খুশি হবেন নাই-ই
বা কেন——-
পাত্র হিসেবে অর্ণবকে পাওয়া মানে খুবই ভাগ্যের ব্যাপার- ম্যাথে অনার্স নিয়ে সাইন্স গ্রাজুয়েট অর্ণব সিআরপিএফ -এর খুবই ভালো একটা পোস্টে সার্ভিস করে– বাবার বড় ব্যবসা আছে –একটি মাত্র বোন আছে বাড়িতে -বোনের বিয়ে হয়ে গেলে– নির্ঝঞ্ঝাট ফ্যামিলি—
যাই হোক দুই ফ্যামিলির সম্মতিতে -মোটা পণের বিনিময়ে- অর্ণব আর পর্নার বিয়েটা -খুব ভালভাবেই সুসম্পন্ন হয়ে যায়-
শ্বশুরবাড়িতে আসার পরে- শশুর শাশুড়ি ননদের— ভালোবাসা দেখে- পর্ণা অনেকটাই অবাক হয়ে যায়– -মানুষ এতটাও ভালো হতে পারে????
স্বামী অর্ণবের ক্ষেত্রে তো কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়– নিতান্ত নম্র-ভদ্র আর খুব মনোযোগী একজন সঙ্গী-
যার ভালোবাসার গহীন সবুজ ছায়ার -শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পাশাপাশি একসাথে থেকে -সারা জীবন অনায়াসে
কাটিয়ে দেওয়া যায় ——–
কিন্তু মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় পর্নার—অতিরিক্ত কোন কিছু পতন ডেকে নিয়ে আসে খুব তাড়াতাড়ি–
কিন্তু মানুষের নিজের হাতে তো আর কিছুই থাকে না—–
টানা ছাব্বিশ দিন পর্ণা আর অর্ণব একসাথে একাত্মা হয়ে সময কাটানোর পর -অর্নবের ডিউটিতে জয়েন করার ডেট চলে আসে –চোখের জলকে লুকিয়ে পর্ণা অর্ণবকে হাসিমুখেই বিদায় জানায়——
দুপুরে বিছানায় একা একা শুয়ে– চঞ্চলা হরিনীর মত খুশির তরঙ্গে ভেসে চলা পর্নার মনটা –আজ হয়ে যায় -বিচ্ছিন্ন নির্জন দ্বীপের মত নিশ্চল——
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল পর্ণা- বুঝে উঠতে পারেনি– ঘুমটা ভাঙলো ননদ রুনুর ডাকে—-
রুনু এসে পর্নার পাশে বসে –খুব মিষ্টি করে বলে— –বৌদি——- বলছি বাবার তো বিজনেসটা-এখন ভালো যাচ্ছে না –তাই বাবা বলছিলেন যে যদি তোমার বাবা কিছু টাকা ধার দেন আর কি—-
পর্না কথাটা শোনা মাত্রই–বলে উঠলো -এটা কখনোই সম্ভব নয় -আমার বাবা আমার বিয়ে দিতে গিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন —
পর্নার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই রুনু মুখ ভার করে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়–
রাতে ডিনার টেবিলে আবার কথাটা ওঠায় পর্নার শ্বশুরমশাই—–
বলছিলাম কি বৌমা –তোমার বাবাকে বোলো —-মানে বেশি কিছু না –পাঁচ লাখ টাকা মাত্র –আরে আমি সব শোধ করে দেবো –আসলে এখন ব্যবসাটা একটু বড় করবো ভাবছি— এক-দু মাসের মধ্যেই শোধ করে দেবো তোমার বাবার, সব টাকা—–
পর্ণা এবার একটু মেজাজ নিয়েই বলে ওঠে –দেখুন বাবা– আমার বাবার অলরেডি অনেক দেনা হয়ে গেছে –আমার বিয়ে দিতে গিয়ে –তাছাড়া এখনো আমার দুটো বোন আছে –তাদের পড়াশোনা —নাচ গান —প্রচুর খরচা বাবার— আপনি বলছেন কি করে ??? আপনি বরং আপনার ছেলেকে বলুন- লোন নিতে —আর আমার বিয়ের তো এখনো এক মাসও হয়নি— আমি যদি এই মুহূর্তে আমার বাবার কাছে টাকা চাই —আপনাদের মান সম্মান থাকবে তো?? না বাবা আমি পারবোনা- আমাকে ক্ষমা করে দেবেন———
পর্নার মুখে স্পষ্ট জবাব শুনে –পর্নার শ্বশুরমশাই রেগে গরম ডালের বাটি সমেত খাবারের প্লেট টা -পর্নার দিকে ছুঁড়ে ফেলে –খাবারের টেবিল থেকে না খেয়েই উঠে চলে যান——
পর্ণা তো হতভম্ব— গরম ডালের বাটিটা হাতে পরাতে- হাতটা হুহু করে জ্বলতে শুরু করে -পর্ণা ছুটে যায় বাথরুমে– এবার শুরু হয় শাশুড়ির বিষ মাখা জীভের বচন—-
হায় হায় গো —কি অলক্ষী মেয়েকে বাড়িতে আনলাম আমি- শশুরের মুখে মুখে চোপা -খেতে পর্যন্ত দিলোনা মানুষটাকে গো—এ তো দেখছি একটা আপদ এসে জুটেছে আমার বাড়িতে——
ননদ রুনু বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে –বেশি জল নষ্ট করো না —ইলেকট্রিক বিল কি তোমার বাবা দেবেন— বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছুটে নিজের রুমে চলে যায় পর্ণা– আতঙ্কে পুরো শরীরটা তরতর করে কাঁপতে থাকে—কি করবে ভেবে উঠতে পারে না পর্ণা– একবার ডাবে বাবাকে ফোন করে সব জানাবে —আবার ভাবে অর্ণব কে ফোন করা যাক–কিন্তু দুটোর কোনটাই করে উঠতে পারে না পর্ণা—-
হাতের জ্বলনটা কিছুতেই কমছে না দেখে পর্ণা– একটু টুথপেষ্ট নিয়ে জ্বলনের জায়গাটায় লাগিয়ে নেয়—- সারারাত চোখের ঘুম হারিয়ে যায় পর্ণার– ভোর পাঁচটার সময় শাশুড়ি মাতা এসে জানিয়ে দিয়ে যায় –কাজের মেয়েকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে –এবার থেকে বাড়ির সমস্ত রকমের কাজকর্ম এবং রান্না-বান্না পর্ণা কে একাই করতে হবে———
শ্বশুরবড়ির এই বর্বরতা পূর্ণ আচরণ দেখে পর্ণার ভাষা বিষ্ময়ে বাক্যহীন হয়ে যায়—
নিরবে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে– পুড়ে যাওয়া হাত নিয়ে– ননদ শ্বাশুড়ীর সব রকমের টিটকিরি বটকরা কে উপেক্ষা করে–একাহাতেই সব কাজ শেষ করে ফেলে পর্ণা—
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে পর্নার সাথে কেউ কোন কথা বলেনা—-
খাওয়া শেষ করে পর্ণা নিজের রুমে এসে হাতের পোড়া দগদগে ঘায়ের উপর –আবার কিছুটা টুথপেস্ট লাগিয়ে– তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ করে ফেলে–ক্লান্ত শরীর ছিল -তাই খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পরে পর্ণা –চারটের সময় যখন ননদ দরজায় নক করল– তখন পর্নার ধুম জ্বর—–
পর্ণা কাতর স্বরে বলে ওঠে –আমি উঠতে পারছিনা —সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা–সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ি মাতা প্রবেশ করেই বলে ওঠেন -কোন কথা শুনবো না– বাড়িতে কোনো কাজের মেয়ে নেই– কে এত কাজ করবে শুনি??????
পর্ণা টলতে টলতে উঠে গিয়ে কষ্টের সাথেই আবার নিরবে সব কাজ শেষ করে ফেলে —
রাত দশটার সময় নিজের রুমে এসে আর সহ্য করতে পারে না পর্ণা —ফোন করে অর্ণবকে –সমস্ত কথা জানায় —সব কথা শোনার পর অর্ণব শুধু একটা কথাই বলে —আমি কাল আসছি –পর্ণা জিজ্ঞাসা করে কিভাবে আসবে কাল ???অর্ণব বলে প্লেনে –তুমি কিন্তু কাউকে জানিও না আমার আসার খবর টা—-
সকালে উঠে জ্বর গায়ে নিয়েই– পর্ণা আবার সব কাজ কমপ্লিট করে নীরবে —দুপুরে সবাই যখন খাবার টেবিলে খাবার খেতে বসে –ঠিক সেই মুহূর্তে –অর্ণব এসে হাজির হয়-পর্ণা ছাড়া সবাই তো অবাক –পর্নার শ্বশুরমশাই বলে উঠেন– কি ব্যাপার হঠাৎ তুই এলি ???অর্ণব বলে কলকাতায় কিছুদিনের ডিউটি আছে তাই আসা—
এবার অর্ণবের নজরে আসে পর্নার পুড়ে যাওয়া হাতটার উপর–অর্ণব পর্ণা কে আতঙ্কের স্বরে জিজ্ঞাসা করে উঠে
কি হয়েছে তোমার হাতে?????
পর্নার শাশুড়ি ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে-আরে পর্ণা কে গরম ডাল দিতে গিয়েছিলাম ভুলবশত ওর হাতে গরম ডাল এর বাটিটা পরে গেছে–
অর্ণব খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে–মা আমি কি কথাটা তোমাকে জিজ্ঞাসা কররেছি ??তুমি চুপ করো–
এবার পর্ণা নির্দ্বিধায় সকলের সামনে সমস্ত ঘটনা স্পষ্টভাবে বলে দেয় অর্ণব কে—
সব কথা শুনে অর্ণব তার বাবাকে বলে উঠে তোমার টাকার দরকার ছিল তো তুমি আমাকে বলতে পারতে বাবা——– এ তোমরা কি করেছ ????? বাড়ির ঝি ছাড়িয়ে বাড়ির বউকে ঝি বানিয়েছো?? হাতটা পুড়ে গেছে পর্নার –ডাক্তার পর্যন্ত দেখাও নি??? তোমরা কি মানুষ?? ছিঃছিঃছিঃ– আমার লজ্জা হচ্ছে তোমাদেরকে বাবা-মা ভাবতে—
ছেলের কথা শুনে বাবা করা মেজাজে বলে ওঠেন- একটা কথা শুনে রাখ- আমার বাড়িতে তোর বউকে থাকতে গেলে- ঝি এর মতই থাকতে হবে -এর থেকে বেশি কিছু সম্মান দেওয়া আমাদের কারোর পক্ষে সম্ভব নয় -আর তুই যদি আমার মতের বিরুদ্ধে যাস -তাহলে রাতের অন্ধকারে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব কিন্তু—
বাবার কথা শুনে অর্ণব ভাষা হারায়– কিছু না খেয়েই পর্ণা কে নিয়ে চুপচাপ রুমের মধ্যে চলে যায়-এরপর পর্ণা কে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে –বাবা-মাকে না বলেই- পর্ণা কে নিয়ে যায় তার বাপের বাড়িতে–
পর্ণার বাপের বাড়িতে –পর্ণা কে দুদিন প্রাণভরে ভালবেসে শুধুমাত্র একটি কথাই বলে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অর্ণব–সব ঠিক হয়ে যাবে– বেশি চিন্তা করো না–
ব্যাংক থেকে কুড়ি লাখ টাকা তুলে অর্ণব নিজের বাড়িতে ফিরে আসে– বাবার হাতে সেই টাকা তুলে দিয়ে বলে– বাবা এই টাকাটা রাখো –পর্নার বাবা দিয়েছেন– আর আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা– আমি ভুল করে তোমাদেরকে অনেক কথা শুনেছি —টাকা পেয়ে তো অর্নবের বাবা খুব খুশী—-
গভীররাত পর্নার শ্বশুরমশাইয়ের ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়- কিসের যেন পোড়া পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে –তাড়াতাড়ি করে উঠে আসেন তিনি -উঠে এসে দেখেন ছেলের রুম থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া বের হচ্ছে—
চিৎকার করে পাড়া-প্রতিবেশীদের ডেকে দরজা ভাঙ্গা হয়- ততক্ষণে অর্ণব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে—-
খবরটা পর্নার কাছে পৌঁছানো মাত্রই পর্ণা জ্ঞান হারায়- কিছুদিন পর অবশ্য পর্নার জ্ঞান ফিরে আসে -কিন্তু পর্ণা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে -দীর্ঘ টানা ছয় মাস পর ডাক্তারি চিকিৎসার মাধ্যমে পর্ণা আবার বাস্তবে ফিরে আসে–
সবকিছু মনে পড়ে যেতে চোখের জলকে আর ধরে রাখতে পারেনা পর্ণা– হঠাৎ মনে পড়ে যায় অর্ণবের একটা ছবি আছে বাবার টেবিলের ড্রয়ারে –কোনক্রমে উঠে বাবার টেবিলের ড্রয়ার টা খুলতেই- পর্নার হাতে পড়ে যায় অর্ণবের মৃত্যুর আগে পর্নার উদ্দেশ্যে লেখা শেষ চিঠি–
পর্ণা
———-
প্রথমেই বলে রাখি আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়- আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যু বরণ করেছি -তুমি বা তোমার ফ্যামিলির কেউ আমার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে কোনো লিগ্যাল স্টেপ নেবে না-আর হ্যাঁ –আমি চাই তুমি তোমার জীবনে দ্বিতীয় জীবন সাথী কে খুঁজে নিয়ে খুব খুব সুখী হও– জানি আমাকে ভুলে যাওয়া তোমার পক্ষে খুবই কঠিন- কারন এটা যে স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনা -তবুও বলছি চেষ্টা কোরো -এটাই হয়তো ভবিতব্য ছিল -যাইহোক এই কিছুদিন তোমার মধুর ভালোবাসায় আমি পূর্ণ -তোমাকে হয়তো অপূর্ণ রেখেই চলে গেলাম -সব ওলট-পালট হয়ে গেল পর্ণা– ক্ষমা করে দিও প্রিয়া –ভালো থেকো——-
ইতি- অর্ণব( শুধু তোমার অর্ণব)
চিঠির শেষ করে পর্ণা স্মৃতির আয়নায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে –উদাস চোখে তাকিয়ে রইল জানালার বাইরে নীল আকাশের দিকে —আর দুচোখ বেয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উপচে পড়তে লাগল নোনতা জল—–
নুপুর ব্যানার্জি
34 comments
Comments are closed.
Add Comment