বড়মামা বারবার অনুরোধ করা সত্বেও মুখের উপর না করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আমি জীবনে ব্যারিষ্টার হব। আমাদের ঔপনিবেশিক দেশ যুক্তরাজ্য হবার কারনে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সত্বেও ঔপনিবেশিক মন স্বাধীন না হবার কারনে বাংলাদেশে ব্যারিষ্টারকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। বি.এস.সি. পাশ করার পর সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম বাড়িতে কোনকিছু না জানিয়ে। শুধু মা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল। উত্তরে বলেছিলাম বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি।
দীর্ঘদিন মুন্সীগঞ্জ কলেজে পড়ার সুবাদে যখন তখন বাড়ি থেকে বেরুলেও কখনোই বেশি কৈফিয়ত দিতে হতো না। প্রথম প্রথম প্রতিদিন প্রায় সাড়ে এগারো কিলোমিটার পথ সাইকেলে করে কলেজে যেতাম। অলিরটেক বাজার থেকে তালতলা বাজার আঠারো কুড়ি মিনিট, চরমশুরা মসজিদ থেকে খাজা চিসতির দরগা পনেরো ষোল মিনিট। সেখানে নিজাম স্টোর থেকে পুরা ফাঁকা মেঠো পথ পার করে মুন্সীর হাট বাজারে,পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট এবং মেইন রোড ধরে কলেজে পৌঁছুতাম এক থেকে সওয়া ঘন্টায়। রাস্তায় কোথায় কয়টা গর্ত, কোথায় সন্ধ্যার পর ভয় থাকতে পারে, কোন রাস্তার মোড়ে কোন ভাজার দোকান, এমনকি কোন বাড়িতে কয়টা মেয়ে আছে, সব ছিল আমার নখদর্পণে। বর্ষাকালে আমার কোন বর্ষাতি ছিল না। তাই কোন কোনদিন বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসে যেতাম। একবছর পর থেকে মুন্সীগঞ্জেই একটা বাসায় পেইং গেষ্ট হিসাবে ছিলাম। সাইন্স নিয়ে পড়ার দৌলতে কয়েকদিনের মধ্যেই বেশকিছু স্টুডেন্ট নিয়ে চুটিয়ে টিউশনি করতাম।
জেনি আন্টি আমাকে ভীষণ পছন্দ করত। বছরের বিভিন্ন পরবে যখন ওনারা দেশের বাসায় যেতেন, আমাকেই সমস্তবাড়ির দেখভাল করতে বলে যেতেন এবং কোনো না কোনো দামি গিফট নিয়ে আসতেন আমার জন্য। আন্টি বলতেন “তুমি যখন বার অ্যাট ল করতে লন্ডনে যাবে আমার সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করবে। বি.এস.সি কমপ্লিট করার আগেই উনি আমার পাশপোর্ট করে দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে এবং তারজন্য একটি টাকাও দিতে হয়নি আমাকে।
একবুক আশা নিয়ে ফিরদৌসদের বাড়ি হয়ে দু’জনে ওদের পার্সোনাল গাড়ি নিয়ে ঢাকার আগামাসি লেনের কাছে একটা মিডিয়াম মাপের লজে উঠলাম। সঙ্গে ফিরদৌসের আম্মা-আব্বাও আছেন। খালারা ফ্রেশ হচ্ছেন। আমি একটা আলাদা রুমে আমার সঙ্গে আনা ব্যাগটা রেখে কলেজের পথে হাটা দিলাম। সিটি ল’কলেজ, 62/আগামাসি লেন, ঢাকা। বিরাট প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকছি আর যেন ভেতরটা আনন্দে ভরে উঠছে। জীবনের প্রথম স্বপ্নপূরণের একটি সোপানে পা রাখতে চলেছি, ভেবে। ভর্তির ডেট আগামীকাল সকাল দশটা থেকে। মেইন গেট দিয়ে ঢুকেই খুউব সুন্দর উজ্জ্বল বাদামী রংএর ইট বিছানো তিনটি রাস্তা তিনদিকে গেছে। বড়মামার কাছে শুনেছিলাম এইরকম ইট বিছানোকে বলে হেরিং বোন বন্ড। বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাস্তাই ইটের। দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলে বলেন- ডানদিকে বয়েজ হোস্টেল, মস্তবড় একটা পাড় বাঁধানো দিঘি বরাবর সোজা গেলে, গেট নম্বর তিন। আর বাঁ দিক দিয়ে গেলে প্রশাসনিক ভবন। স্বাভাবিক ভাবেই বাঁদিকের রাস্তা ধরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমার মতো আরো বেশ কয়েকজন উৎসুক ছাত্রছাত্রী এদিক সেদিক জটলা পাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। বিল্ডিংএর সামনের দেওয়ালে একটা নোটিশ বোর্ডের সামনে কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে উৎসাহ নিয়ে আরো একটু এগিয়ে যাই। বিস্তারিত লেখা – অ্যাডমিশন ফি, টিউশন ফি ছাড়াও যারা হোস্টেল নিতে চায়, তারজন্য মোট প্রদেয়। মনে মনে হিসাব কষে নিলাম। বড়মামার কথাগুলো কেন যেন বারবার মনে পড়ছে, বিরক্ত লাগে। তিনি বলতেন, এতো সুন্দর মেধাটাকে নষ্ট করিস না ইন্দ্র। সাইন্স নিয়ে পড় ব্রাইট ফিউচার আসবে জীবনে। বড়মামা তখন ইন্ডিয়ায়।
আই.আই.টি. খড়গপুরে পি.এইচ.ডি. করছেন। মামা ফিজিক্স-কেমিষ্ট্রিতে ডিসটিঙ্কশন মার্কস পেতেন বরাবর। কলেজে খুব নাম ছিল। আমাকে মাঝে মাঝে পড়াতে বসলে চিৎকার করে মাকে ডাকতেন আর বলতেন- “আমি তো ইন্দ্রের কাছে শিশু রে রমা। তোর ছেলে একদিন তোদের বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে, মিলিয়ে নিস আমার কথাগুলো।” আমাকে বলতো – “ডাক্তার হবি না ইন্জিনিয়ার?” ব্যারিষ্টার হ’ব, কথাটা বলতে চাইলেও বলতে পারতাম না। সত্যিই মুন্সীগঞ্জের প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট আমার তারিফ করত। এমনকি প্যারেন্টসরাও বাড়িতে গিয়ে পড়ানোর জন্য জোড়াজুড়ি করত। সুদকষা, জটিল জটিল সব উৎপাদক, ডেরিভেটিভ, ত্রিকোণমিতি, ফিজিক্সের জটিল ইকুয়েশন, কেমিস্ট্রির গাণিতিক সূত্র ও তার প্রমাণ – সব পদ্ধতিগুলো এমনভাবে বুঝিয়ে দিতাম আর আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে তাক লেগে যেত সবাই। শুধু কি বিজ্ঞানে? ইংরেজিতেও ছিল সমান দক্ষতা।
কিরে, কি করত্যাছিস একা একা? তর জন্য তো আম্মু এখনো কিছুই খাইলই না- ফিরদৌসের কথায় সম্বিত ফিরে পাই। কলেজটার চারদিকটা সবাই মিলে আরেকটু দেখে নিয়ে ফিরে আসি।
আজ এল.এল.এমের রেজাল্ট হাতে নিয়ে ফোন দিয়েছিলাম বাড়িতে। বড়মামাকে ট্রাই করেছি কয়েকবার, আউট অফ রিচ নয়তো সুইচড অফ শুনিয়েছে অপর প্রান্ত থেকে। এরমধ্যে বাসাও বদল করেছি। কলেজ থেকে একটু দূরে। এইদিকটায় হই-হট্টোগোল কিছুটা কম। রাস্তার মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে যেতে যেতে কি মনে হল, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সামনে নেমে পড়লাম। হেটে চলেছি আর ভাবছি ঢাকাতেই বি.পি.টি.সি. অর্থাৎ বার প্রফেশনাল ট্রেইনিং কোর্স করলেই ব্যারিষ্টার হওয়া যাবে। আর যদি লন্ডনে গিয়ে বার ভোকেশনাল কোর্স করা যায় তবে দশ থেকে পনেরো হাজার পাউন্ড মানে বাংলাদেশি টাকায় দশ থেকে পনেরো লাখ। এক কোটি টাকার বার অ্যাট ল’ করা আমাদের মতো পরিবারের স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভাবতে ভাবতে কোর্ট ক্যান্টিন পার করে একেবারে আদালত চত্বরে ঢুকে পরেছি। দূর থেকে, খুব পরিচিত নাম আমানত স্টোরের পিছনে ল্যান্ড অফিসের পাকুর গাছতলাটার দিকে নজর পড়ল। হ্যাঁ, নিজাম আখতারই তো! আমাদের সিনিয়র। দুই বছর আগেই বেড়িয়েছে ও। একজন নিম্ন আয়ের পরিবারের বোরখা পরা মহিলার সাথে কথা বলছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিকই দেখছি। আখতারদা কিছু খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ঐ মহিলাটির ঢেলে দেওয়া পানি দিয়ে কেন? এবং টিফিন ক্যারিয়ারটিও পরিস্কার করতে দেখলাম ঐ মহিলাকেই। উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলে কে যেন পেছন থেকে হাত টেনে ধরে। আরে ইন্দ্র এখানে? ওহ জুলফিকারদা। একই ইয়ারে ছিল আখতারদা আর জুলফিকারদা। দুজনই একজন দক্ষ ল’ ইয়ারের কাছে প্রাকটিস করছে কলেজ থেকে বেরিয়ে। অনেকবার ওদের সঙ্গে অ্যাডভোকেটদের প্রাকটিস নিয়ে কথা হয়েছে পার্সোনাল ইন্টারেষ্ট থেকে। জুলফিকারদা, কি একটা বিষয় যেন লুকোনোর চেষ্টা করে। ও ঠিক বুঝতে পারে, আমি কোন এক কৌতূহল নিরসনের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলাম। যতবার আমি প্রসঙ্গ টানতে গেছি ও ততবারই অন্য পথে হেটে আমার কৌতূহল কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে ছোট্ট উত্তর দেয়, “তুমি গেলে দোস্ত আমার শরমে মরে যাবে।” -মানে? উত্তরে বলে, মহিলাটির স্বামীর পারিবারিক দ্বন্দ, জটিল আইনী প্যাঁচ আর আদালতের ব্যয়, উকিলের মাশুল গুনতে গুনতে সমস্ত ভিটে-মাটি চলে যেতে বসেছে। কিন্তু তবুও তার স্বামী কোর্ট থেকে ছাড়া পায়নি। বর্তমানে মহিলা নিরুপায় হয়ে আখতার ভাইয়ের জন্য প্রতিদিন খাবার বানিয়ে আনে। আর দিনের শেষে ভাইয়ার বাড়ি হয়ে ফিরে যায়। শুনেছি মহিলাটির কোনো এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় সামান্য কিছু টাকা দেয়, সেটা দিয়েই প্রতিদিনের খাবার নিয়ে আসে। শেষের কথাগুলো আর কান পর্যন্ত পৌঁছুতে পারেনি। প্রফেসর ড. বোরহান উদ্দিন খানের ‘অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি’ বইটির, অপরাধ বিজ্ঞানের ইতিহাস, কেন অপরাধ বিজ্ঞান তৈরী হয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তা, শাস্তি এবং অপরাধ বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ – এই কথা লেখাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বইয়ের পাতাগুলো কে যেন আমার উপড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর আমি দুহাতে একটার পর একটা পাতা উল্টে খুঁজে চলেছি। –অর্ডার, অর্ডার। ওপাশ থেকে কারা যেন বলছে, শাস্তি চাই, শাস্তি চাই।