২ বছর পর দেশে ফিরলাম। সব যে অচেনা লাগছে তা না। অনেক জিনিস আছে যা দেখে হঠাৎ কিছু স্বৃতি মনে পরে। আমি হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছি। এই ২ বছর পড়াশুনা আর জীবন ব্যাস্ততায় যা ভুলে ছিলাম,আসলে যা ভুলে থাকার চেষ্টায় ছিলাম,আজ দেশে ফিরে অসম্ভবভাবে সেগুলো নাড়া দিয়ে উঠছে।
রিংকি,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যে শুধু মুখে বেস্ট ফ্রেন্ড নয়, সব সময় পাশে থাকার মতো একজন। যার সাথে কথা বলার সময় আমার হিসেব করে কথা বলতে হত না।
হিমু,আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষ। যার মতো করে আমি কোনদিনই অন্য কাওকে মনে বসাতে পারব না।
২ বছর আগে আমি এদের কোন কিছু না জানিয়েই দেশের বাহিরে চলে যাই। একদম হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার মতো। হয়তো তারা আমাকে পাগলের মতো খুজেছে, আমার ফোনে, ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম সব জায়গায় নক দিয়ে গেছে আমার খোজে। আমার বাসায় গিয়েছে, কিন্তু আমাকে পায়নি। বরং তাদের মিথ্যা বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা জানে না আমি কোথায়। আমিও জানি না তারা কোথায়। এমনকি এটাও জানি না তারা আমাকে মনে রেখেছে কিনা।
আমার গাড়ি এখন রেড লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাত প্রায় ১০ টা বাজে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার বাম পাশেই একটা স্কুল আছে। এই স্কুলে পড়ার সময়ই আমার রিংকির সাথে পরিচয় হয়। ওর কথা খুব মনে পড়ছে। ও আমাকে কোনদিনই ক্ষমা করবে না এভাবে তাকে ছেড়ে হঠাৎ করে চলে যাওয়ায়। কিন্তু আমার আর কোনো উপায় ছিলো না।
সবুজ বাতি জ্বলে গেছে, গাড়ি স্টার্ট দেব এখন কিন্তু আমার চোখ আটকে গেলো রাস্তার পাশে একজনের দিকে। আরিয়ান হেঁটে চলে গেলো। সে আমাকে লক্ষ্য করেনি। আমি গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। ভাবছি আরিয়ানের সাথে কি আমার কথা বলা উচিৎ ছিলো? রিংকির সাথে কি ওর বিয়ে হয়েছে? হাইস্কুল থেকে রিংকির সাথে ওর ভালো একটা সম্পর্ক। যেহেতু আরিয়ানের দেখা পেলাম হঠাৎ করেই, আমি আশা করছি যেন রিংকি আর হিমুকেও আগের ঠিকানায় পেয়ে যাই। কিন্তু আমি কোন মুখে ওদের সামনে দাঁড়াবো?
শেষ যেদিন আমার সাথে ওদের দেখা হয়েছিলো সেদিনটি এখনও স্পষ্ট মনে পরে। খুব স্বাভাবিক দিন ছিলো। আমি আর রিংকি একসাথে কলেজ করলাম তারপর হিমু আর আরিয়ান সহ একটা ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিলাম। কিছু এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার লাস্ট ডেট এসে যাচ্ছিলো তাই রিংকি বলল পরের দিন সকালে ওর বাসায় চলে আসতে। আরিয়ানের ছোট বোনের বিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই। ও প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকবে। পরের দিন সন্ধ্যায় বিয়েতে কি কি করব সেটা নিয়ে প্ল্যান করার কথা ছিলো। আরিয়ান বার বার বলছিলো মায়া আর হিমুকে দিয়ে একটা কাপল ডান্স করাবে। আমি ওকে বলেছিলাম যেদিন তুমি রিংকিকে বিয়ে করবে সেদিন আমি হিমুর সাথে কাপল ডান্স করব। হিমু আরিয়ানের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,ভাই আরিয়ান তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নাও,তাহলে আমি মায়ার সাথে ডান্স করার সুযোগ পাবো। এসব কথা নিয়ে সেদিন অনেক হাসি ঠাট্টা হচ্ছিলো। কিন্তু পরের দিন.. কেও আর আমাকে খুজে পেলো না। যেনো আমি কোনোদিন এ পৃথিবীতে ছিলামই না। আমার কোনো অস্তিত্বই ছিলো না।
(বর্তমান ১০ই জানুয়ারি)
পরের দিন সকালে আমি ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠালাম। স্বপ্ন দেখেছি,খুব খারাপ স্বপ্ন। ভয়ে আমি প্রায় ঘেমে গেছি। এখনও বুক ধড়ফড় করছে। কি স্বপ্ন ছিলো এটা? আমি প্রায় সময় স্বপ্ন দেখলে তা ভুলে যাই কিন্তু এটা আমার পুরোটা মনে আছে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে একটা সাদা ঘর। দরজার সামনে রিংকি দাঁড়িয়ে আছে। ও আমাকে বলল, ভেতরে আসবি না? আমি ভেতরে যাব এই মুহূর্তে দেখলাম রিংকির পেছনে একটা মেয়ে। হুবুহু রিংকির মতো দেখতে। শুধু একটি পার্থক্য সেটা হচ্ছে ওর মুখ থেকে গাঢ় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটি পেছন থেকে রিংকির গলা চেপে ধরলো এবং টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। আমি ভেতরে দৌড় দিলাম কিন্তু যেয়ে দেখি রিংকির মতো দেখতে মেয়েটি রিংকিকে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারছে। স্বপ্নটা তখন পালটে গেলো। আমি দেখলাম অন্ধকার রাস্তায় হিমু আর আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। একটা গাড়ি এসে ওদের পাশে থামলো। ওরা গাড়িটায় উঠে পড়লো কিন্তু পেছন থেকে অনেক স্পিডে এসে একটা ট্রাক গাড়িটাকে জোরে ধাক্কা দিলো, গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে আগুন লেগে গেলো। কিন্তু তারপর দেখলাম ট্রাক থেকে দুজন বের হয়ে এলো। তারা আর কেও নয়,আরিয়ান আর হিমু। ট্রাক থেকে বের হয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলো দুজনে।
স্বপ্নটা শুধু ভয়ংকর না,আজব ও। এবার মনে হচ্ছে সত্যিই আমার ওদের সাথে দেখা করা দরকার। হোক তারা রেগে আছে আমার ওপর কিন্তু তারা সুস্থ, ঠিক আছে কিনা এটা জানা খুব দরকার। আমি ঠিক করে ফেললাম আজকে রিংকির পুরান বাসায় যাবো। তার আগে আমার ব্যাক্তিগত একটা প্রতিশোধ নেওয়া বাকি আছে সে কাজটা করতে হবে। আমি ফোন করলাম রাহাতের কাছে। কয়েকবার রিং হতেই ও ধরলো।
“আরেহ কি ভাগ্য আমার! মায়া সুন্দরী আমাকে ফোন করেছে?”
“বাজে কথা বন্ধ করো। কালকে তোমাকে একটা কাজ করতে বলেছিলাম করেছো?”
“আমি তো রেডি আছি। তুমি শুধু জায়গাটা বলো,রিস্ক তো আমার বাড়িতে নেব না”
“একটা হোটেল বুক করে ফেলো। আমার নামে করবে, আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাজটা আমি আজকেই হওয়া চাই।”
“ওকে মেডাম রাহাতকে দিয়ে কোনোদিন কোনো অকাজ হয়নি”
আমি ফোন কেটে দিলাম। লাগেজ সব গুছানো আছে কারণ আমি কালকেই দেশে এসেছি। এখন এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। বাড়িতে এমনিতেও কেও থাকে না। আমার মা নেই আর বাবা বিজনেস এর কাজে সব সময় বাহিরে। কেয়ার টেকাররাই যা দেখাশুনা করে।
আমি সব জিনিস নিয়ে বের হবো এমন সময় দেখি বাবা চলে এসেছে। আমাকে দেখে মধুর একটা হাসি দিয়ে বলল,
“কোথায় যাচ্ছো মা? তুমি কালকেই ফিরলে না?”
কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই তবুও বললাম,”তুমি নেই বাবা তাই বন্ধুর বাসায় যাচ্ছিলাম”
“আমি এসে গেছি! আজ একসাথে লাঞ্চ করব। তুমি এসেছো জন্যেই আমি এত সকাল সকাল চলে আসলাম মা”
“ভালো”
আমি লাগেজ নিয়ে রুমে চলে গেলাম। রাহাতকে ফোন করলাম।
“হ্যা রাহাত তুমি তোমার কাজ সেরে ফেলো আমি ২ দিন পর হোটেলে উঠব”
“কি বলছো তুমি! এই ২ দিন আমি কিভাবে কি করব!”
“আরেহ তুমি এমন ভাব করছো যেন আমি তোমাকে ক্ষুণ করে লাশ লুকাতে বলেছি! রিল্যাক্স, এটুকু কাজ করতে পারবে না?”
“ক্ষুণের থেকে কমও তো না!”
আমি ফোন কেটে দিলাম। বাবা এসে সব প্ল্যান ভেস্তে দিলো। ঠিক করলাম এখনই বের হবো রিংকির খোজে।
আমি বেরিয়ে পরলাম। রিংকির বাসা বেশি দূরে নয়। হেঁটেই যাওয়া যায় আমি তাই গাড়ি নিলাম না। আমি রিংকির বাসার সামনে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কি বলব আমি ওকে? সব সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক এর মতো মনে পড়ছে।
২ বছর আগের কথা। আমার বাবা বড় একজন বিজনেস ম্যান। সে চায় আমি পড়াশোনা করে অনেক উন্নতি করে তার সাথেই কাজ করি। সেই সাথে উনি ছিলেন অনেক স্ট্রিক্ট একজন মানুষ। আমার কোনো বন্ধু বান্ধবদের দেখতে পারতেন না। অতিরিক্ত অহংকার থাকলে যা হয়। উনি চায় আমি ভালোমতো পড়াশোনা করি কিন্তু সেদিকে আমার কোনো মনযোগ ছিলো না। আমার রেজাল্ট ছিলো খারাপ। আর আমি রিংকি,হিমু এদের নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম। কিন্তু তাও বাবা সেটা মেনে নিচ্ছিলেন শত বকা ঝকার পরেও। তারপর কলেজে একটা ঘটনা ঘটে গেলো। যে কারণে আমাকে এক্সপেল করা হলো কলেজ থেকে। বাবার ধৈর্যের সীমা এ পর্যন্তই ছিলো। বাবা বিশিষ্ট ব্যাক্তি হওয়ায় আসলে আমাকে এক্সপেল করেও তারা সেই চার্জ তুলে নেয় এবং আমি আবার কলেজ করতে পারি। কিছু দিন পর সব নরমাল হয়ে আসলো কিন্তু বাবার একটাই কথা ছিলো রিংকি,হিমু কিংবা আরিয়ান কারো সাথে আমি যেন আর কোনরকম যোগাযোগ না রাখি। আমি বাবার কথা শুনলাম না। আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু করানোর ক্ষমতা উনার নেই। কিন্তু উনার ইগো এতটাই বেশি যে উনি অন্য ফাঁদ পাতলেন। তারপর থাক অন্য সময় বলা যাবে। এখন আমি রিংকির বাসায় যাব।
আমি কলিংবেল চাপলাম। ভেতর থেকে বলে উঠলো, কে? আমি কি বলব,আমি মায়া? কিছুই বললাম না,রিংকির মা দরজা খুললেন। খুলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমার জন্য এভাবে কাঁদার কথা না। কি হয়েছে? পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম।
আমাকে উনি ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।আমি বললাম, রিংকি নেই?
উনি এখনও অপ্রকৃতস্থের মতো কাঁদছেন। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে উনি বললেন, “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?”
“আন্টি এটা অনেক বড় কাহিনি। আমি পরে বলি? রিংকি কোথায়? ও বাসায় নেই?”
“তুমি চলে যাও। ও শুধু বাসায় না, ও এই দুনিয়া থেকেই বিদায় নিয়েছে”, বলেই উনি ওড়নার মুখ দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
আমি যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না। একটা ঘোরের মধ্যে আমি,মনে পরে গেলো সেই স্বপ্নটার কথা। রিংকি নিজেই নিজেকে কুপিয়ে মারছিলো।
(চলবে….)