আমার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে মায়ের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি, একটা মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু গন্ধটা পাওয়ার কথা নয় কারণ মা তো চার মাস আগেই ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছেন। পুলিশের ধারণা ওটা নাকি দূর্ঘটনা আর বাবা বলেছে মা নাকি আত্নহত্যা করেছে কিন্তু আমার দুটোর একটাও ঠিক মনে হয়না। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধটা এখনো পাচ্ছি, কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটা মাথায় টর্নেডোর মতো ঘুরছে কিন্তু এর উত্তর পাচ্ছি না। আমার ঘরে তো মায়ের কোনো কাপড়ও নেই যে সেটা থেকে গন্ধ আসবে, নাকি গন্ধটা আমার মস্তিষ্কের কল্পনা? না, গন্ধটা একদম তীব্র, এতো তীব্র গন্ধ উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা হতে পারে না।
এখন ঘড়িতে সময় একটা বেজে পনেরো মিনিট। নিশুতি রাত, গোটা শহর এখন ঘুমোচ্ছে। না ভুল বললাম, ঢাকা শহর তো ঘুমোয় না, রাতে আরও রঙিন হয়ে ওঠে। আমার পানির পিপাসা পেয়েছে কিন্তু ঘরে পানি নেই। পানি খেতে হলে আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে কিন্তু আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি খাটের উপর পা তুলে বসে আছি, ঘুম আসছে না। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধটা এখন আরও গাঢ় আর তীব্রভাবে পাচ্ছি। এতো তীব্রভাবে গন্ধটা এর আগে কখনো পাইনি। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো ঘরের দরজার ঠকঠক শব্দে। এতোরাতে আমার দরজায় কে টোকা দিচ্ছে? বাবা? বাবার তো এতেরাতে জেগে থাকারই কথা না, তাহলে কে? বাড়িতে তো আমি আর বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। দুইজন কাজের লোক আছে কিন্তু তারা তো সন্ধ্যার আগেই বাড়ি চলে যায়। দরজার ঠকঠকানির শব্দটা ক্রমশ আরও জোরে হতে শুরু করলো আর তার সাথে সাথে মায়ের গায়ের গন্ধটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। আমি এবার বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কে এতোরাতে দরজায় কড়া নাড়ছে এটা দেখা দরকার। আমার হাত কেন কাঁপছে এটাও বুঝতে পারছি না, আমি কি ভয় পাচ্ছি? বোধ হয় পাচ্ছি, নাহলে হাত কাঁপবে কেন? আমি কাঁপা কাঁপা হাতেই দরজা খুললাম, কিন্তু একি দরজার বাইরে তো কেউ নেই। তাহলে দরজায় টোকে কে দিচ্ছিলো? ড্রয়িংরুমে কেউ লুকিয়ে আছে কি না সেটা দেখার জন্য আমি ঘর ছেড়ে বের হলাম। না, দোতলার কোত্থাও কেউ নেই। আমাদের বাড়িটা তিনতলা। আমরা থাকি দোতলায় আর বাকি দুই তলা ফাঁকা। তবে বাবা ঠিক করেছেন, ওগুলো ভাড়া দিয়ে দেবেন, একা একা থাকতে তার নাকি ভালো লাগে না। ভাড়াটিয়া এলে বাড়িটা ভরে থাকবে।
সে যাই হোক, ওসব কথা এখন থাক। এখনকার কথা বলি, ড্রয়িংরুমে কাউকে দেখতে না পেয়ে আমি বাবার ঘরে গেলাম। বাবা আমার ঘরের দরজায় টোকা মারছিলেন কি না এটা জানার জন্য। বাবার ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে তাই বাবার ঘরের দরজা সবসময় খোলায় থাকে, বন্ধ ঘরে তিনি ঘুমোতে পারেন না। বাবার ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলাম, বাবা বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়েই বুঝলাম বাবা আজও মদ্যপান করেছেন, কারণ মদের উগ্র গন্ধে ঘর ছেয়ে আছে। এই বদভ্যাসটা বাবার অনেকদিনের পুরনো। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, বাবা সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বন্ধুদের আড্ডায় চলে যেতেন তারপর মদের নেশায় বেসামাল হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতেন। ওসব নিয়ে মা কিছু বললেই, বাবা সেই অবস্থাতেই মাকে যাচ্ছে-তাই ভাবে মারধর করতেন। মা শরীরের যন্ত্রণায় কয়েকদিন বিছানা থেকেই উঠতে পারতেন না, জ্বরে গা পুড়ে যেতো তখন মায়ের মাথায় পানি ঢালতে হতো। আমি তো তখন ছোট ছিলাম, ওতো কিছু বুঝতাম না, শুধু বুঝতাম, মা ভালো নেই। মা তখন জ্বরের ঘরে আমাকে কাছে টেনে বলতেনঃ মা পিয়ু শোন, তোর বাবা একটা বদলোক। ওই বদলোকের কাছে তুই একদম যাবি না, বাবা বলেও ডাকবি না।
আমি মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু এখন আর আমি ছোট নেই, আমি এখন ভার্সিটি পড়ুয়া বাইশ বছরের তরুণী তাই এখন ওই বিষয়গুলো আমার কাছে পরিষ্কার। বাবা মায়ের উপর উদাসীন হলেও আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং এখনও বাসেন। ছোটবেলায় আমিও বাবাকে খুব ভালোবাসতাম কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর থেকে আমি বাবাকে একদম সহ্য করতে পারছি না, দেখলেই রাগ লাগে। আমার ইদানিং বাবাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। এখনও ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে বাবার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিতে। আমার চিন্তায় দাঁড়ি দিতে হলো কারণ মদের উগ্র গন্ধে বাবার ঘরের দরজায় বেশিক্ষণ আর দাঁড়ানো গেল না, আমি আমার ঘরের দিকে রওনা হলাম। আমার ঘরে ঢুকেই, আমার রক্তহিম হয়ে গেল। বাবার মতো আমারও একটা ফোবিয়া আছে, আমি অন্ধকারে ভয় পাই। এই ফোবিয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় কি বলে? তা আমার জানা নেই। অতিরিক্ত আলোতেও আবার ঘুম হয়না আমার তাই অন্ধকারের ভয়ে সারারাত আমার ঘরে ডিমলাইট জ্বলে। ডিমলাইটটার আলো সবুজ রঙের তবে আলো খুব স্পষ্ট। ওই আলোতে ঘরের সবকিছুই একদম স্পষ্ট দেখা যায়। আমি বাবার ঘর থেকে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই ডিমলাইটের সবজে আলোয় দেখলাম, আমার বিছানার উপর পা তুলে মা বসে আছেন। হ্যাঁ, মাকেই দেখছি আমি। কিন্তু মা কি করে আসবেন আমার ঘরে? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আমি ভয়ের চোটে ঘর ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় মা আমাকে বললেনঃ পিয়ু, আয় মা আমার পাশে বস।
না, এ আমার কল্পনা নয়। মা সত্যিই এসেছে আমার ঘরে। মায়ের পরনে লাল রঙের সুতি শাড়ি তবে সবজে আলোতে শাড়ির রঙ কালচে দেখাচ্ছে। আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মা তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বললেনঃ কেমন আছিস রে মা?
– ভালো নেই, ইদানীং আমার কিছুই ভালো লাগে না। তুমি কেমন আছো মা?
– এতোক্ষণ ভালো ছিলাম না, এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। ওই বদলোক আজও মদ গিলে এসেছে তাই না?
– হুম,এখন তো বাইরে যায় না, ঘরে বসেই খায়। মদের গন্ধে বাবার ঘরে যাওয়া যাচ্ছে না।
– তুই যাবি কেন? তোকে না বলেছি, ওই বদলোকের কাছে যাবি না, বাবা বলেও ডাকবি না। ওই বেয়াদব মহিলার সাথে বিয়ে-শাদি করবে নাকি তোর বাপ?
– নিতু আন্টির কথা বলছো?
– হুম।
– নিতু আন্টি সেদিন এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। বিয়ের কথাও শুনলাম তখন।
– করবে বিয়ে তাই না? আমি জানতাম, ওই বদলোক, আমাকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে ঠিকই ওই নিতুকে বিয়ে করবে। তোর বাপ তো ওই নিতুর নাগর, তলে তলে তো ওর সাথেই ফষ্টিনষ্টি চলতো। ওই জন্যই তো আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ওই বদলোক।
– কি বলছো মা? বাবা….
– হ্যাঁ, ওই বদলোকই সেদিন রাতে আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে আর পুলিশকে বলেছে, আমি নাকি আত্নহত্যা করেছি কিন্তু পুলিশ আবার আমার হত্যাকে দূর্ঘটনা ধরে বসে আছে।
– কিন্তু মা, বাবা তোমায় আগে মারলো না কেন? এতে বছর পর কেন মারলো?
– আরে বুঝিস না? তুই যখন ছোট ছিলি তখন যদি মারতো তাহলে তোর দায়-দায়িত্ব নিতে হতো আর এখন তো তুই বড় হয়ে গেছিস তাই তোর দায়-দায়িত্ব নেওয়ার দরকার হবে না। বদটা এখন ওই ডাইনির সাথে সুখে সংসার করতে পারবে।
– হুম কিন্তু মা তুমি তো মরে গেছো, তাহলে আমার সাথে কথা বলছো কিভাবে?
– ধুর পাগলি মেয়ে, মা কি তার আদরের মেয়ের সাথে কথা না বলে থাকতে পারে? আরও আগে আসতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। আচ্ছা ওসব কথা ছাড়, তুই একটা কাজ করতে পারবি?
– কি কাজ?
– কাল সকালে পুলিশে ফোন করে বলবি, আমার মৃত্যুটা কোনো দূর্ঘটনা নয়, তোর বাবা নিতু নামের মহিলাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে রাস্তা ফাঁকা করেছে। পারবি না?
– পারবো।
– লক্ষ্মী মেয়ে আমার। আচ্ছা, আমি এখন যাই। আমি মাঝে মাঝেই আসবো তোর সাথে দেখা করতে।
– আচ্ছা।
– তুই এতো রাত জাগিস কেন? ঘুমা, ঘুম শরীরের জন্য খুবই জরুরি।
এ কথা বলে মা আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেনঃ আসি রে মা, ভালো থাকিস। সময় করে আবার আসবো।
মায়ের চোখে অশ্রু জমেছে, মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। মায়ের চলে যাওয়া দেখতে দেখতেই আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম। সকালে বাবা ঘুম থেকে ওঠার আগেই মায়ের কথামতো পুলিশে ফোন করে সবটা বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে পুলিশ হাজির হলো, বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। বাবা তখনও ঘুমিয়ে ছিল। চাকরের ডাকে ঘুম থেকে উঠে বাড়িতে পুলিশ দেখে বাবা বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তারপর পুলিশের মুখে আমার করা অভিযোগের কথা শুনে বাবা অবাক হয়ে আমাকে বললেনঃ এসব কি বলছিস মা? রেশমাকে আমি কেন মারবো?
আমি হিংস্র স্বরে বললামঃ একদম নাটক করবে না বাবা। আমি ভালো করেই জানি, মাকে তুমি ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছো।
বাবা এবার পুলিশের এসআই কে বললেনঃ অফিসার, আপনি ওর কথায় কান দেবেন না, বেশ কিছুদিন ধরে ও কিছুটা অসুস্থ।
আমি এবার রাগে বাবার উপর আক্রমণ করে বসলাম। বাবার গলা টিপে ধরে একনাগাড়ে বলতে থাকলামঃ তুমি আমার মাকে মেরেছো, আমি জানি, তুমি মেরেছো। মা আমাকে বলেছে তুমি ওই নিতু আন্টিকে বিয়ে করার জন্য মাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছো। তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে বাবা।
বাবা প্রাণপণে আমার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তারপর হঠাৎই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন নিজেকে একটা চেয়ারে বসা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলাম, এটা একটা ক্লিনিক। আমার সামনে বসে আছেন, বাবার পুরনো বন্ধু ফরহাদ আঙ্কেল। উনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে? আমি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখেই ফরহাদ আঙ্কেল বললেনঃ পিয়ু মা, এখন কেমন আছো?
– আমি সুস্থ আছি আঙ্কেল। আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে?
– তোমার বাবার কাছে শুনলাম….
ওনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি বললামঃ যা শুনেছেন সব ঠিক শুনেছেন।
– ওহ কিন্তু পিয়ু মা, ওগুলো যে তোমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা, এটা তো তোমাকে বুঝতে হবে। যে চলে যায়, সে কি আসে রে মা? আসে না।
– কে আসে না আসে আমি জানি না। কিন্তু মা যে সত্যি আসে, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ইভেন, মা এখনো এখানেই আছেন, আমি দেখতে পাচ্ছি।
– তাই? কোথায়?
– আপনার পেছনে।
– ওহ, তা উনি কি করছেন এখন?
– এমনি দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু মা বলছেনঃ আপনি একটা বোকা।
ফরহাদ আঙ্কেল আমার সাথে আর কোনো কথা বললেন না। আমাকে আর বাড়ি পাঠানো হলো না, আমাকে এডমিট করা হলো ফরহাদ আঙ্কেলের ক্লিনিকেই। আমি ওসব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না কারণ আমি জানি কদিন পর এরা এমনিই আমাকে ছেড়ে দেবে। কেবিনের বেডে শুয়ে শুয়ে দেখলাম, একটু দূরে ফরহাদ আঙ্কেল বাবাকে বলছেন, আমার নাকি সিজোফ্রেনিয়া, হ্যালুসিনেশন, ডিমেনশিয়া ইত্যাদি মানসিক রোগ হয়েছে। এককথায় ওনারা আমাকে পাগল সাজাতে চাচ্ছেন, যাতে মায়ের হত্যার ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়। আমাকে বোধ হয় ঘুমের ওষুধের ইনজেকশন দিয়েছে, আমি আর তাকিয়ে থাকতেই পারলাম না। এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমে ঢলে পড়লাম। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে। চোখ মেলে দেখলাম, মা আমার বেডের পাশে বসে আছেন। কেবিনটা অন্ধকার তবে করিডোরের আলোয় কেবিনে টিমটিমে আলো ঢুকছে। হালকা আলোয় দেখলাম, মা মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। আমি মাকে জিজ্ঞেস করলামঃ কি হয়েছে মা?
– তোর বাবাকে আমি মেরে ফেলেছি।
– ওহ।
– ওহ আবার কি? জিজ্ঞেস করবি না কিভাবে কি করলাম?
– বলো।
– ঘন্টাখানেক আগে দেখলাম তোর বাবা মাতাল অবস্থায় সিগারেট খেতে খেতে ছাদে পায়চারি করছে। আমি ভাবলাম কিছু প্রশ্ন করি। হঠাৎ তোর বাবার সামনে গিয়ে বললামঃ তুমি আমাকে কেন মারলে শফিক? আমাকে বললেই তো আমি তোমাদের পথ থেকে সরে যেতাম।
তোর বাবা আমাকে দেখে প্রথমে খুব ঘাবড়ে গেল তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেল। হয়তো তোর বাবা ভেবেছিল, মাতাল অবস্থায় ভুলভাল দেখছে। তাই আমি আবার প্রশ্নটা করতেই তোর বাবা বেশ জোরেই বললঃ আমি ভালো করেই জানতাম রেশমা, তুমি কখনো পথ ছেড়ে যেতে না আর তাই তো….
তখন আমার হঠাৎই খুব কান্না পেল, আমি কাঁদলাম, তোর বাবা দেখলো তারপর আবার সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে শুরু করলো। আমি একবার ভাবলাম, চলে আসি ওখান থেকে কিন্তু পরমুহূর্তেই খুব রাগ হলো, তখন তোর বাবাকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলাম।
পিয়ু, আমি ঠিক করিনি?
– হুম।
– তোর কি তোর বাবার জন্য কষ্ট হচ্ছে?
– না।
– হচ্ছে না তাহলে কাঁদছিস কেন?
– কাঁদছি এই ভেবে, যদি বাবা ওরকম কিছু না করতেন তাহলে আমরা সুখে থাকতাম, হ্যাপি ফ্যামিলি হয়ে। কিন্তু তা আর হলো কই?
– কাঁদিস না মা, ওসব ভেবে আর কি হবে? বাদ দে ওসব। শোন, তোকে এখান থেকে ছেড়ে দিলে তুই আর ওই বাড়িতে থাকিস না। ওই বাড়ি ভাড়া দিয়ে তোর বড়খালার কাছে চলে যাস, একা থাকার দরকার নেই। আমি তাহলে যাই এখন।
– মা, তুমি আর আসবে না?
মা আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেনঃ না রে মা, আমার সময় শেষ। আমি আর আসতে পারবো না, তুই ভালো থাকিস। কখনো নিজেকে একা ভাববি না। সবসময় ভাববি তোর মা তোর সাথে আছে, ঠিকাছে? আমি যাই রে, পিয়ু সোনা, ভালো থাকিস।
আমার খুব কান্না পাচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতেই কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। সকালে ঘুম ভাঙলো নিতু আন্টির ডাকে। গতকাল রাতে মা যেভাবে বসে ছিলেন, ঠিক সেভাবেই এখন নিতু আন্টি বসে আছেন। মায়ের মতো দুধে-আলতা গায়ের রঙ না হলেও নিতু আন্টি বেশ রূপবতী মহিলা। নিতু আন্টি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে
বললেনঃ পিয়ু তুমি কিছু শুনেছো? তোমার বাবা ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, পুলিশ বলছে আত্মহত্যা। এসব কি থেকে কি হয়ে গেল পিয়ু, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
নিতু আন্টি অঝোরে কাঁদছেন, আমি ওনাকে কাঁদতে দিলাম। ওনার কান্নার গতি কমার পর বললামঃ বাবাকে মা মেরেছে।
নিতু আন্টি যারপরনাই অবাক হয়ে বললেনঃ কি??
– হুম, ঠিকই শুনেছেন। এরপর আপনার নাম্বারও আসতে পারে, সাবধানে থাকবেন।
[ যদিও আমি জানি মা আর আসবেন না কিন্তু আমার মনে হলো এই মহিলাকেও একটু শাস্তি দেওয়া উচিত, তাই অজানা ভয়টা ওনার মনে গেঁথে দিলাম। কমপক্ষে, এক-দেড় মাস তো উনি মৃত্যুভয়েই দিন পার করবেন।]
– পিয়ু এসব কি বলছো তুমি?
– ঠিকই বলছি। এখন আপনি বিদায় হন, আপনার সাথে কথা বলছে ভালো লাগছে না।
ফরহাদ আঙ্কেলও বোধ হয় ভয় পেয়েছিলেন, উনি ক্লিনিক থেকে সেদিনই আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে শেষ দেখা দেখতে আমি যায়নি। কেন যাবো? পারতপক্ষে, উনি আমার মায়ের খুনি। মায়ের খুনির মৃত্যুশোকে কি কেউ সামিল হয়? হয় না তাই আমিও হইনি। আমাদের বাড়িটা একজন কেয়ারটেকারের হাতে জিম্মি করে আমি সেদিনই রওনা হয়েছিলাম বড়খালার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওই ঘটনার আজ তিন বছর অতিক্রম হলো। মায়ের কথা এখনো পড়ে কিন্তু মা আর আসে না। তবে, মায়ের গায়ের সেই মিষ্টি গন্ধটা আমি এখনও মাঝে মাঝে পাই।