হিমু চরিত্রটাকে বই এর জগতে মোটামুটি সবাই চেনে। তবে আজকে বলি অন্য এক হিমুর গল্প। এই হিমুর রূপা নেই তবে সে আমাকে বলে মায়াবী। তাই আমার নাম মায়াবী। সংক্ষেপে মায়া।
তখন বর্ষাকাল,মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার বাড়িতে গ্রুপ স্টাডি করার নামে রিন এসে ফোন টিপছে,আমিও ফোন হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে গল্প করছি। রিন হঠাৎ বলল, “মায়া তোকে না হিমু লাইক করে”। আমি বললাম, “অহ”। বলে আবার ফোন এর দিকে নজর দিলাম।
“আমার কথা টা পাত্তাই দিলি না?”, রিন বলল।
“বললামই তো”
“তোকে আগেও অনেক বার বলেছি। কেন এরকম করিস। বলবি কথা বলবি?”
আমি চুপ করে আছি।”হিমু ছেলে টা কেমন?”
“ভালো। ভালই আছে খারাপ না। তুই কথা বলে দেখ? ওই অনেক দিন থেকে মায়া মায়া করছে”
“ও কি এইগুলা এমনি ফ্লার্ট করে না?”
“কি জানি কিন্তু তুই কথা বল। ভালো লাগবে। বল না! মজা হবে!”
“কেমনে কথা বলব? জাস্ট মজা করার জন্য তাহলে। কিছু সিরিয়াসলি নেব না”
“হ্যা নিস না ওইটাই ভালো। একটা গ্রুপ খুলি।”
প্রথম প্রথম আমরা কথা বললাম শুধু মজা হিসেবে।মানে আমি জানতাম যে হিমু সব মেয়েদের সাথেই ফ্লার্ট করে আর যেহেতু ও কলেজে পড়ে, তাও আবার ঢাকায় থাকে,ওর অবশ্যই অনেক গার্লফ্রেন্ড আছে আর অনলাইনে অবশ্যই ও এইসব মজা করে থাকে কিছুই সিরিয়াসলি না। ও যদি বলত তুমি আমার চাঁদ, কথাটা জোক হিসেবে নিয়ে আমিও বলতাম তুমি আমার পৃথিবী। এগুলো শুধু কথা ছিলো কোনো অনুভূতি ছিলো না। হিমু বাংলা গান খুব পছন্দ করতো আর আমি ভুলে ভবিষ্যতে বাংলা গান দু’ একটা শুনতাম। হঠাৎ কিছু দিন পর আমি আবিষ্কার করলাম আমার কি জানি হয়ে গেছে। যে আমি বাংলা গান শুনতাম না সে কিনা হিমুর বলা সব গান শুনে ফেলেছে আর ঘরে বসে বাংলা গান বাজায়। কানে ইয়ারফোন লাগিয়েও বাংলা গান শোনে।নিজেকে অবাক ভাবে আবিষ্কার করলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি দূর্বল হয়ে যাচ্ছি আবার ওইদিকে হিমু আমার সাথে জাস্ট মজা করে এসেছে সেটাও আমি জানি। পরে গেলাম দ্বিধা দন্দে। আমি রিন কে জিজ্ঞেস করলাম হিমু কি সিরিয়াস নাকি ও শুধু মজা করে? রিন আমাকে ঠিকমতো কিছুই বলতে পারলো না। আমিই বাধ্য হয়ে হিমুকে জিজ্ঞেস করলাম,তুমি কি রিলেশনশিপ এর ব্যাপার এ সিরিয়াস? সেদিন অনেক কথা হলো কিন্তু আমি তো শুধু বিভ্রান্তই হয়ে চললাম। কারণ ও ঠিক করে বলতে পাচ্ছে না আমাদের কি রিলেশনশিপ এ যাওয়া উচিত কিনা। একবার ভাবলাম এখানেই সব শেষ করে দেই। যে মায়া পড়েছে শুরুতেই কেটে যাক।কিন্তু পারিনি। আমি হিমুর রূপা হতে চেয়েছিলাম।
চলতে থাকল দিনের মতো দিন। আমি গভীর অন্ধকার প্রেমে ডুবে আছি অথচ হিমু ঠিক হিমুর মতো,কাওকে কেয়ার করে কিনা কে জানে।
রংপুরে গিয়েছি আমি আর রিন বিয়ে খেতে। হিমু কয়েক দিন যাবত রংপুর এ আছে বন্ধুর বাসায় সেটা জানতাম। ওর বন্ধুর নাম প্রথম। যতদূর আমি জানি প্রথম রিনকে পছন্দ করে কিন্তু আমাদের কি ভাগ্য আমরা অন্য ছেলে মেয়েদের মতো সব কিছু সহজভাবে নিতে পারিনি। জটিল করে নেওয়া মনে হয় আমাদের স্বভাব ছিলো। কাহিনিটা এমন হতে পারত,হিমু আমাকে সরাসরি বলবে আই লাভ ইউ আর আমি মেনে নিয়ে আর সবার মতো প্রেম করা শুরু করব। কিন্তু জটিল জিনিসটা হয়তো এখানেই,আমরা প্রেমে পড়েছি অথচ কেওই স্বীকার করতে রাজি নই,সব কিছুকে আমরা ফ্লার্ট হিসেবে ধরে নিতে চাই কারণ জানিনা সব শেষে কি আছে,কে কার বিশ্বাস ভাঙবে আর কে কখন হঠাৎ ভাগ্য থেকে চলে যাবে। তখন শুধু কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থকবে না।
বিয়েতে মজা করলাম আমি আর রিন। তবে সেদিন আরও একটা জিনিস ঠিক করলাম, আমরা হিমু আর প্রথম এর সাথে দেখা করব। পরেরদিন কখন কোথায় দেখা করব সব ঠিক হলো। কিন্তু কাহিনিটা হলো রাতে, যে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এত মেয়ে থাকতে হিমু কিভাবে আমাকে পছন্দ করে আর আমি ওকে বিশ্বাসই বা করব কিভাবে, ওর সাথে আমার কিছুদিন এর পরিচয়। এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিলো তখন রাগ করে হিমু বলল,”তোমার আমার প্রতি বিশ্বাস না আসলে, তাহলে থাক বাদ দাও।” কথাটা আমাকে কাঁচ ভাঙার মতো টুকরা করে দিলো। সব শেষে কিনা আমিই সব ভেস্তে দিলাম।রিন শুনলেও মন খারাপ করবে। ও অনেক খুশিতে আছে কালকে প্রথম এর সাথে দেখা করবে। আমি আর রাতে ওকে কিছু বললাম না।
সকালে রিন রেডি,দেখা করতে বের হবে। আমি বাহানা দেওয়ার চেষ্টা করছি আমার শরীর ভালো না। কাজে দিলো না কারণ আমি কি আর আমার এই বেস্ট ফ্রেন্ডটার জেদ এর সাথে পারি? ওকে বলতেও পারব না হিমুর সাথে এসব কাহিনি হয়েছে আর কাল থেকে আমরা কথা বলিনি। মন সায় দিলো না তাও রেডি হলাম,আর নিজের মনকে আশা দিলাম প্রথম এর সাথে হিমু ও আসবে, ওকে আমি সরি বলব। আমরা গেলাম রংপুরের একটা সুন্দর পার্কে। রিন আমাকে জোর করে একটা নীল সিল্কের শাড়ি পরিয়েছে। আজ প্রথমবারের মতো আমি মিষ্টি একটা বাঙালি সাজ দিয়েছি। কিন্তু পার্কে যেয়ে আবিষ্কার করলাম হিমু আসেনি। রিন প্রথমকে পেয়ে অনেক খুশি আর হিমুকে যাচ্ছেতাই গালাগাল করে যাচ্ছে,হিমুর সাথে ওর অনেক দিনের বন্ধুত্ব তাই মুখে যা আসছে তাই বলে দিচ্ছে। এবার আমার মনে হলো না আসাই ভালো ছিলো। আমি কেনো কাবাব মে হাড্ডি। একটা বেঞ্চে বসে আমি রিন কে বললাম তোরা যা আমি এখানে বসে থাকি। রিন বাচ্চাদের মতো করতে থাকল,বলল “তোকে এখানে একা রেখে আমরা ঘুরব?তুইও যাবি।” আমি বললাম,”আমার শরীরটা ভালো না তোকে আগেই বলেছি এখন হাটলে মাথা ঘুরে পরে যাব আর আমার ভালো লাগছে না তোরা ঘুরে আয় আমি একটু এই সুন্দর জায়গাটায় বসে থাকি। ভালো লাগবে আমার।” অনেক কষ্টে ওকে আমি প্রথম এর সাথে পাঠাতে পারলাম আর আমি বেঞ্চে বসে থাকলাম,কার জন্য নীল শাড়ি পড়ে এসেছি? আমার কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু এখানে বসে কাঁদলে মানুষ কি বলবে। তাই বুকে রক্তক্ষরণ হলেও চেপে রাখলাম নিজের মাঝে।
এমনিতেই বর্ষাকাল। আকাশের ওপর ভরসা নেই। কিছুক্ষণ পরই আকাশে বিশাল বড় কালো মেঘ জমা হলো বোঝাই যাচ্ছে একটু পর সেও আমার মতো কেঁদে ফেলবে।ঝড় হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ভাবছি আজ মনের দুঃখে এখানেই ভিজব। এমন সময় রিন ফোন দিলো। বলল পার্ক থেকে বের হয়ে আয় আমরা এখন বাসায় যাব। একটু সামনে এগিয়ে আয় আমরা তোর জন্য দাঁড়িয়ে আছি। আমি পার্ক থেকে বের হয়ে সামনে এগোতে থাকলাম। বিদ্যুৎ চমকে উঠলো একবার। শুধু বিদ্যুৎ না তার সাথে আরও কি জানি শব্দ শুনলাম মনে হলো পেছন থেকে কে জানি ডাকছে। “মায়া!”পেছন ফিরে দেখি আর কেও নয়, হিমু। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি, ও আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ওর হাতে কদম ফুল। জানে এটা আমার খুব পছন্দের। আমার সামনে এসে কদমগুলি ধরে বলল, “আমি শুধু তোমার হতে চাই,আমাকে ভালোবাসবে মায়াবী?”
একটা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ সেখান থেকে গান বেজে উঠল, “♪ roadside food আর বৃষ্টি, নীল শাড়িতে লাগছে মিষ্টি ♪”। আমি এতটাই অবাক যে হঠাৎ করে কিছুই বলতে পারলাম না আর সৃষ্টিকর্তার কি খেলা, হঠাৎ তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো।
বি:দ্র: দোকানে যে গান বেজেছিলো সেটা হিমুর প্ল্যান ছিলো আর রিন ও এসব জানতো। ইচ্ছে করেই ওরা এসব করেছে!